ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

নৃত্যঝঙ্কারে মেতে উঠেছিল মণিপুরী মহারাসলীলা

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২০
নৃত্যঝঙ্কারে মেতে উঠেছিল মণিপুরী মহারাসলীলা মণিপুরীদের মহারাসলীলা উৎসব | ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: মঞ্চজুড়ে রঙের ছড়াছড়ি, বাহারি রঙের পোশাকে ঝলমল করছে নৃত্যপ্রাঙ্গণ। শিল্পীরা সুসজ্জিত হয়ে মঞ্চে এসে পড়েছেন, প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিল রেখে সেইসব পোশাক সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে।

সোমবার (৩০ নভেম্বর) মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরে দিনব্যাপী শুরু হয় মহারাসলীলা উৎসব। স্থানীয় তেঁতইগাঁও গ্রামের মধুমঙ্গল শর্ম্মা মণ্ডপে তখন নৃত্যঝংকার। প্রতি বছরের মতো এবারও এই বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষণে হাজারো মানুষ ছুটে এসেছেন।

শিশু-কিশোর শিল্পীদের পাশাপাশি বয়স্ক নৃত্যশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রীরা দৃষ্টি কেড়েছিলেন সবার। বয়স তাদের দমাতে পারেনি, খোলের মাঝে অভিজ্ঞ আঙুলের আঘাত সুর-লহরী ছড়িয়ে দিয়েছিল মণ্ডপজুড়ে।

মণিপুরীদের গোত্র মূলত তিনটি। মৈতৈ, বিষ্ণুপ্রিয়া এবং মীতৈ পাঙান। মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী এবং মীতৈ পাঙান ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। সনাতন ধর্মের দুই মণিপুরী অনুসারীদের সবচেয়ে বড় উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরণ বা রাসপূর্ণিমা নামের মণিপুরিদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শ বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে) পালিত হয়ে আসছে।

কার্তিক বা অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে দূরদূরান্তের লাখো ভক্ত-দর্শক সিলেট বিভাগের মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর ইউনিয়নে এই মহারাস লীলা পালিত হয়ে আসছে।

উৎসব পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ সিং বাংলানিউজকে বলেন, এটি আমাদের ৩৫তম আয়োজন। ১৯৮৫ সাল সাল থেকে এই মহা রাসলীলা আমরা শুরু করেছিলাম। তখন এর পরিধি ছোট ছিল। ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। ভানুগাছ লৈবাক ফালু ও মণিপুরী সাংস্কৃতিক পরিষদ এই উৎসবের আয়োজক। এবার করোনা সংক্রমণের জন্য আমরা আমাদের এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন কিছুটা সংক্ষিপ্ত করেছি।

উৎসবের তাৎপর্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রস থেকেই রাস শব্দের উৎপত্তি। রাস হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তম মধুর রস। আর লীলা মানে খেলা। অর্থাৎ রাসলীলা মানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধা ও তাদের সখী-সাথীদের লীলাখেলা। মণিপুরী সমাজের নীতি অনুযায়ী রাসনৃত্য আবার ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো—মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপীরাস ও দুখলরাস। এর মধ্যে মহারাস হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

আয়োজক সূত্রে আরো জানা যায়, রাসপূর্ণিমায় রাসলীলা উৎসবের শুরুটা হয় গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য দিয়ে। এ নৃত্য হয় সকালে। যারা রাখাল নৃত্যে অংশ নেন তারা প্রথমে মণ্ডপে গোল হয়ে গোপী ভোজন করেন। এ মহারাস লীলায় মণিপুরী শিশু-কিশোরী মেয়েরা এ নৃত্যে অংশ নেয়। যারা এ নৃত্যে অংশ নেয় তারা এক ধরনের বিশেষ পোশাক পরে। ঝলমলে এ বিশেষ পোশাকের নাম পোৎলোয়।

সন্ধ্যার পর শুরু হয় রাসলীলার পূর্ব মুহূর্তে নিপা পালা। পূর্ণিমার রাসলীলা বা রাসনৃত্য পরিবেশন করে মণিপুরী কুমারী মেয়েরা। রাস নৃত্যের সময়ও পোৎলোয় পরা হয়। পোৎলোয় পোশাকের মাথার উপরিভাগের নাম কোকতুম্বী। এ পোশাকের মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ আবরণ থাকে। তার নাম মাইখুম। রাসনৃত্য ও গোলাকার মণ্ডপে কখনও একক, কখনও দ্বৈত এবং কখনও দলবেঁধে পরিবেশিত হয়।

রাসলীলা উপলক্ষে তেঁতইগাঁও গ্রামে বসেছে গ্রামীণ পণ্যের মেলা। এতে মণিপুরী শিল্পীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তলোয়ার নৃত্য, মশাল নৃত্য, মার্শাল আর্ট, নাচ, গান, পুঙ-চোলোম, ঢোলক নৃত্যসহ বিভিন্ন নাচ-গান উপস্থাপন করে থাকেন।

মণিপুরীদের এই উৎসব কেবল মণিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই আর। উৎসবটি এখন একটি বিশেষ মৌসুমে সার্বজনীন উৎসবের পরিণত হয়েছে। যেখানে দূরদূরান্ত থেকে আসা হাজারো মানুষের পদচিহ্নের ছাপ ফুটে ওঠে প্রতি বছর।

বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০২০
বিবিবি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।