তিউনিসিয়ান ঔপন্যাসিক হাবিব সেলমির জন্ম ১৯৫১ সালে আল-আলা শহরে। প্রকাশিত হয়েছে আটটি উপন্যাস ও দুইটি ছোটগল্প সংকলন।
১.
‘শহুরে জীবন তোকে গিলে ফেলেছে’, রুমের মাঝখানে একটা চেয়ার টেনে বসে আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললো ও। পেনসিলের মতো দেখতে একটা লাইটার দিয়ে তামাকের পাইপে আগুন দিতে দিতে আরও বললো, ‘তোর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। চোখে-মুখে দ্যুতি নেই। তবে বেশ হ্যান্ডসাম হয়েছিস তুই। ’
সামনের টেবিলে লাইটারটা রাখার পর আমি আরেকটু ভালো করে দেখে নিলাম। জিনিসটা সুন্দর। ওর কফিতে চুমুক দেওয়ার শব্দ আমার কানে আসছিলো, সঙ্গে পিরিচে কাপ রাখার টুন টুন শব্দটাও।
‘তোর মা বলেছেন, অনেক দিন হলো তুই তাকে দেখতে যাস না। তোর শূন্যতা তাকে খুব পোড়ায়। তিনি অবশ্য জানেন না, এতো বড় শহরে এতো সুন্দর একটা বাড়িতে থাকিস তুই। ’
আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো। একবার মনে হলো, ওর সামনে থেকে উঠে চলে যাই। কিন্তু পারলাম না। দয়ার বশবর্তী হয়ে নয়, কাজটা ভুল হতে পারে, এই আশংকায়। প্রতিটি ভুল আমাকে দারুণ পীড়া দেয়।
২.
আমাদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ছিলো বড়জোর এক মিটার। ওর বিশাল দেহটা মাংসের স্তূপের মতো চেয়ারে লেগে ছিলো আটসাট হয়ে। দশ বছর আগে যে ভঙ্গিতে কথা বলতো, সেদিনও একইভাবে বলছিলো- যেনো কিছুই বদলায়নি। ফোন করে ও যখন দেখা করতে চাইলো, আমি সঙ্গে সঙ্গেই বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কীভাবে আসতে হবে তাও বলে দিয়েছিলাম। মেট্রো স্টেশন, এভিনিউ, বাসা, ফ্ল্যাট নম্বর, সবই। বলেছিলাম, সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। কারণ, কুলিরা ওদের স্বার্থেই সিঁড়িতে মোমের প্রলেপ লাগিয়ে রাখে। তাই উপরে ওঠার সময় রেলিং ঘেঁষে থাকাই ভালো, এতে পিছলে পড়ার ঝুঁকি থাকে না। ও ঠিকমতোই বাসা খুঁজে বের করেছিলো।
৩.
টেবিলের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে লাইটারটা ও প্যান্টের পকেটে ভরলো। ওকে তখন দেখতে কচ্ছপের মতো লাগছিল। ও আবারও শব্দ করে কফিতে চুমুক দিলো, চেয়ারে হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘তোর মা আমাকে বলেছেন, ছোট বেলায় তোর দাঁত গজাতে বেশ সময় নিচ্ছিলো। তোর মামা নাকি প্রায়ই মজা করে বলতেন, তুই আজীবন দাঁত ছাড়াই থাকবি। ’ তামাকের পাইপটা মুখ থেকে সরিয়ে ও হো হো করে হেসে উঠলো।
৪.
হঠাৎ পুরো রুমটা রোদে ভরে গেলো। এতোক্ষণ লাইট জ্বলছিলো, আমি উঠে গিয়ে নিভিয়ে দিলাম। পুরো রুমটা এবার ও ভালো করে দেখলো। আমার দিকে না তাকিয়েই বললো, দেয়ালের ওই পেইন্টিংগুলো, ওগুলো কি আসল?
আমি বললাম, ‘না’।
‘তাহলে ঝুলিয়ে রেখেছিস কেন?’
বললাম, ‘ওগুলো আমার পছন্দের’।
ও আমার দিকে তাকালো। বুঝলাম, আমার জবাব ওকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে একটা পেইনটিং দেখিয়ে ও আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘ওটার অর্থ কী’?
সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে আমি ছবিটা পর্যবেক্ষণ করার ভান করলাম। একটু সময় নিয়ে জবাব দিলাম, ‘অনেক অর্থ আছে’।
আমি এভাবেই কথা বলছিলাম, কারণ আমি আসলে ছবিটার কোনো অর্থ খুঁজে পাইনি। এর আগে কোনোদিন চেষ্টাও করিনি। সত্যি বলতে, এই প্রথমবারের মতো আমি আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলাম, ছবিটা কেন আমার পছন্দের।
৫.
আমি উঠে রান্নাঘরে চলে গেলাম। তবে চুলা জ্বালাবার উদ্দেশ্যে নয়। উদ্বেগ আর বিষণ্নতা ক্রমশ আমার উপর জেঁকে বসছিলো, তাই। কিছুটা প্রশান্তির আশায় রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ধূসর ছাদগুলোতে অসংখ্য কবুতর বসে আছে। একটা চিমনি দিয়ে চিকন ধোঁয়া উঠছিলো। উবে না যাওয়া পর্যন্ত আমি ওটার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। কাছেই একটা ডুমুর গাছ, এই এলাকায় এটাই একমাত্র গাছ। একটা পাখি, চিনতে পারছিলাম না, কয়েকবার পাক খেয়ে ওই গাছটাতেই বসলো। ভাবলাম, ‘যে পাখিগুলোকে আমি চিনি না, ওটা হয়তো তাদেরই একটা’। ছোট শরীর, ছোট ঠোট। বেশ লম্বা সময় নিয়ে আমি পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। না, তবুও চিনতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিলাম, পাখিদের বিশ্বকোষ ঘাঁটতে হবে। আমার নিজেরই একটা আছে। বেশ অনেক দিন আগে যখন বুঝতে পেরেছিলাম পাখিদের সম্পর্কে আমার জ্ঞান কম তখন ওটা কিনেছিলাম।
৬.
রুমে ফিরে দেখি, চেয়ার ছেড়ে ও সোফায় গিয়ে বসেছে। আমাকে দেখে ও হাসলো, প্রশস্ত হাসি। কী আর করার, আমিও হাসলাম। ততোক্ষণে আমার বিষণ্নতা কেটে গেছে। ও এতোক্ষণ যে চেয়ারটায় বসেছিলো আমি সেটায় বসলাম- সামান্য বাঁকা হয়ে, মুখটাকে রোদ থেকে বাঁচাবার জন্য। ও সোফার কুশনে হেলান দিয়ে বসেছে- পা ছড়িয়ে, হাঁটুর উপর হাত রেখে। ওর ডান হাতের নখের দিকে আমার দৃষ্টি গেলো। নখগুলো লম্বা, নোংরা। হাত উঠিয়ে ও থুতনি ঘষতে শুরু করলো। ব্যপারটা সম্ভবত ওর নজরে পড়েছিলো।
আমি আবারও সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে ওটার অর্থ খুঁজতে শুরু করলাম। ও বললো, ‘তোর পাঠানো টাকা তোর মা পেয়েছে। কবর মেরামত আর চুনকামের পেছনে খরচ করেছেন’। আমি চমকে গেলাম, ‘কোন কবর’?
‘তোর বাবার’। ও তখনও থুতনিতে হাত বুলাচ্ছিলো।
আমার মনে পড়লো, বেশ কয়েক মাস আগে মা আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন, পেনসিল দিয়ে লেখা। বাবার কবরের কোনো খোঁজখবর রাখি না বলে পুরো চিঠিজুড়েই আমার সমালোচনা। ওই মুহূর্তে মায়ের খবর জানার জন্য আমার মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হলো। কিন্তু ওর কাছ থেকে কিছু জেনে নেওয়ার পরিবর্তে আমি মায়ের মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম।
৭.
কালো মেঘ আবারও সূর্যকে আড়াল করে দিলো। ও বললো, ‘এখানকার আবহাওয়া খুব দ্রুত বদলায়’। আমি বললাম, ‘হু’। ও বললো, ‘আমার ধারণা বৃষ্টি হবে’। আমি বললাম, ‘সম্ভবত’।
এরপর দু’জনেই অনেক্ষণ চুপ রইলাম। নীরবতার ওই দীর্ঘ বিরতিতে স্মৃতি এসে আমাকে বলে গেলো, বৃষ্টি, শামুক আর কচ্ছপ ওর খুব প্রিয় ছিলো। নোনা জল আর মরুদ্যানের জলাশয়ে সাঁতার কাটতেও ও খুব পছন্দ করতো। ওর সঙ্গে আমার কেন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো স্মৃতি হাতড়ে সেই কারণটাও আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলাম আমি। আমরা একসঙ্গেই স্কুলে যেতাম। পরে আমি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। যদিও ডাক্তার হয়ে ওঠা হয়নি। এই শহরে থিতু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি তো নিখোঁজই ছিলাম! শুনেছি, পেশা হিসেবে ও শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলো। আর এখন বেশ বড়সড় রাজনীতিবিদ।
৮.
সম্ভবত আমরা কেউই বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দীর্ঘক্ষণ নির্বাক বসে থাকতে থাকতে আমরা দু’জনেই বেশ বিব্রত বোধ করছিলাম। আমি অবশ্য মনে মনে কথা বলার প্রসঙ্গ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। তবে কিছু বলার আগেই ও উঠে দাঁড়ালো। আমিও দাঁড়ালাম। ও দাঁড়ালে আমাকেও দাঁড়াতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে হুট করেই কেন জানি মনে হলো, আমারও দাঁড়ানো উচিত। দেয়াল ঘেঁষে রাখা একটা বুকশেলফের দিকে ও এগিয়ে গেলো। শেলফটা বইয়ে ভর্তি, উপন্যাস- যার বেশিরভাগই বিদেশি লেখকদের, কবিতা আর ছোট ছোট বিশ্বকোষ। বিশ্বকোষগুলো আমি একটা লাইব্রেরি থেকে চুরি করেছিলাম। কিছুদিন আমি ওই লাইব্রেরিতে কাজও করেছি। শেলফের দিকে ঝুঁকে ও একটা বই বের করলো। পাতা ওল্টাবার আগে বইয়ের নামটা বেশ শব্দ করেই পড়লো। আমি ওর দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘দারুণ একটা উপন্যাস...’। ও বিষয় জানতে চাইলো। আমি যথেষ্ট শৈল্পিকভাবে অতিসংক্ষেপে ওটার কাহিনি বর্ণনা করলাম। ও চুপচাপ শুনছিলো। তারপর বইটা শেলফে রাখতে রাখতে বললো, ‘যুদ্ধের উপন্যাস আমার পছন্দ নয়।
৯.
বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টি দেখার জন্য আমরা দু’জনেই জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। ধূলিমাখা জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছিলো। ও জিজ্ঞেস করলো, ‘ওই কবুতরগুলো তোর জানালার কাছে আসে না’? বললাম, ‘মাঝে মাঝে’।
পাইপে আবারও আগুন দিয়ে ও লম্বা একটা টান দিলো। বললো ‘তোর মায়ের জন্য কিছু দিতে চাস’? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখনই চলে যাবি’?
ও কিছুই বললো না। একবার ভাবলাম, রাতে খাবার খেয়ে যেতে বলি কিন্তু বললাম না। বললাম, ‘না, কিছুই পাঠাবো না। মাকে বলিস, খুব শীঘ্রই আমি তাকে দেখতে যাবো’।
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ও খুব ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। কিছুদূর নামতেই আমি জোরে বললাম, ‘সিঁড়িতে কিন্তু মোম লাগানো আছে’।
রুমে ফিরে সোফায় হেলান দিয়ে বসলাম। ও যে ছবিটা দেখিয়েছিলো সেটা আমার সামনে। আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘নিঃসন্দেহে এটার একটা অর্থ আছে’।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৭ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৬
এসএনএস