ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

একুশের গল্প

প্রতীক্ষা | যুথিকা বড়য়া (পর্ব-২)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
প্রতীক্ষা | যুথিকা বড়য়া (পর্ব-২) একুশের গল্প

প্রতীক্ষা 
যুথিকা বড়য়া 
একুশের গল্প (পর্ব-২)

২.
খোকন ছোটবেলা থেকেই বড্ড একরোখা ছেলে। অনমনীয় ওর জেদ।

বিরল সেন্টিমেন্টাল। প্রতিটা বিষয়েই বিরোধিতা, আপত্তি, অভিযোগ করা ওর চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে প্রখর সংগ্রামী মনোভাব। যেদিন শহরের রাজপথে প্রথম ভাষা আন্দোলনের শুরুতে সংগঠনের নবীন সদস্য আবদুল রশীদ বেকায়দায় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গিয়ে নির্মমভাবে আত্মাহুতি দিয়েছিল তাদেরই বন্দুকের গুলিবিদ্ধ হয়ে- আর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা সমগ্র জনগণের মনে বৈপ্লবিক চেতনার সাংঘাতিক বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সেই বৈপ্লবিক চেতনার বাতাবরণে খোকন আরও গভীরভাবে স্বাধীনতা বিপ্লবের সঙ্গে আরও জড়িয়ে পড়ে। লোকের কানাঘুষোয় শোনা যায়, ‘উজ্জ্বল চৌধুরী (ওরফে খোকন) একজন বিপ্লববাদী স্বদেশী’।

তবু কখনও মনের মধ্যে তেমনভাবে সন্দেহের দানা বাঁধেনি, কোনো প্রশ্নও জাগেনি মমতার। বরং মনে মনে গর্ব হতো। আত্মগর্ভে মায়ের বুক ভরে উঠতো। ভাবতো, স্বদেশী মানেই তো দেশকে ভালোবাসা, দেশের জনগণকে ভালোবাসা, দেশের সেবা করা, দশের সেবা করা, জনগণের সেবা করা। এটা একটা মহৎ কাজ, মহা পূণ্যের কাজ। কিন্তু আজ কোন কার্যালয়ে, কিসের পূণ্য অর্জন করতে গিয়েছে খোকা?

বেলা ক্রমশ বয়ে যাচ্ছে। মমতা তখনও অশান্ত, উদ্বেলিত, মর্মাহত। ক্ষণে ক্ষণে গহীন বেদনানুভূতির তীব্র দংশন আর ভোরের ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের প্রতিচ্ছবি ক্রমে ওর স্নায়ুকোষে ঘুরপাক খাচ্ছে। কখনও জীবন্ত হয়ে মনোচক্ষে দেখা দিচ্ছে। তন্মধ্যে আকস্মিক খোকনের অভাবনীয় ব্যতিক্রম চাল-চলন, কথাবার্তা, বিবর্তিত চেহারা প্রদর্শনে মনের মধ্যে সন্দেহের দানা চাড়া দিয়ে ওঠে মমতার। অজানা আশঙ্কায় ঘিরে ধরে। সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। প্রচণ্ড ভাবিয়ে তোলে। নদীর ঢেউয়ের মতো মস্তিস্কের কোষে কোষে বার বার একটাই প্রশ্ন ফিরে এসে আঘাত করতে থাকে, মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে, মাকে ভাবনার সাগরে ডুবে রেখে, সম্পূর্ণ উপবাসে খোকা আজ গেলো কোথায়?

সেই সকাল থেকে চা-জল-খাবার নিয়ে বসে রয়েছে মমতা। কিছুতেই মুখে ঢুকছে না। ক্ষুধা, তৃষ্ণা কিছুই মালুম হচ্ছে না। কলিং বেলটা একটানা বাজছে, সেদিকেও খেয়াল নেই। হঠাৎ জানালার ধারে বসে থাকা হুলো বিড়ালটা মিঁয়াও করে ডাক দিতেই চমকে ওঠে। বেলের আওয়াজ শুনে ভাবল, বোধহয় খোকা ফিরে এসেছে ।  
 
দৌড়ে যায় মমতা। দরজা খুলে দেখে, একটি অচেনা যুবতী মেয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। কিছু বলবার ব্যাকুলতায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।

অপ্রত্যাশিত অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে ঘাবড়ে গেলো মমতা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটি বললো, ‘মা-মাসিমা, আমি অলকা, উজ্জ্বলের ক্লাসমেট্। কিছুক্ষণ আগে আমাদের পুকুরঘাট থেকে ওকে যেতে দেখলাম মনে হলো। গায়ে চাদর জড়ানো, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। রেললাইন ধরে খুব জোরে হেঁটে যাচ্ছিল। ও কোথায় গেলো আপনি জানেন’?

কম্পিত স্বরে মমতা বলল, ‘তা তো জানি না। বলছিল, ইউনিভার্সিটিতে যাবে। কীসের একটা জরুরি মিটিং আছে। কিন্তু যাওয়ার সময়...!’

মমতার কথা শেষ না হতেই আঁতকে ওঠে অলকা। ‘অ্যাঁ, ইউনিভার্সিটিতে গেছে!’ বলে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকে। ‘সর্বনাশ, ঘর থেকে আজ ওকে আপনি বের হতে দিলেন কেন?’ বলে ধপাস করে সিঁড়িতেই বসে পড়ে অলকা।

ব্যস, পড়ল মরার উপর খাড়া। চিন্তাধারার গতিবেগ আরও তিনগুণ বেড়ে গেলো মমতার। আতঙ্কে বুকের ভিতরটা ধুক্ ধুক্ করে কাঁপতে থাকে। ভয়-ভীতিতে বুক শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে যায়। চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মনে বিভীষিকা। হঠাৎ কান্নাজড়িত কণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে, ‘কার কি সর্বনাশ হবে মা? কোথায় হবে? কেন হবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি নে’!
 
খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে অলকা বললো, ‘কেন? টিভির খবরে কিছু শোনেননি? আজ ইউনিভার্সিটির চারপাশে সরকার একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে। নোটিশ ঠুকে দিয়েছে, ইউনিভার্সিটির ত্রিসীমানায় কোনো মিটিং, মিছিল কিংবা জটলা করা চলবে না। আজ একটা গন্ডোগোল হওয়ার খুবই সম্ভাবনা আছে’!

শুনে চমকে ওঠে মমতা,-‘এ্যাঁ, বলো কি! কিসের মিটিং? কাদের মিটিং? মিছিল করবে কেন ওরা? এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে কেন? গন্ডোগোলটা হবে কিসের জন্য?’

বিস্মিত কণ্ঠে অলকা বলল,-‘সেকি মাসিমা, উজ্জ্বল কিছু বলেনি আপনাকে? আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা করার দাবিতে অনেক ছাত্র-ছাত্রী একজোট হবে, আন্দোলন করবে, আপনি জানেন না? এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা লঙ্ঘন করে, হাতে ঝান্ডা নিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে ওরা এসেম্বেলীর দিকে যাবে। পুলিশ নিশ্চয়ই তখন ওদের উপর হামলা করবে, লাঠিচার্জ করবে, কাঁদানি গ্যাস ছুড়বে। ব্যস, শুরু হয়ে যাবে ঘোরতরো গন্ডোগোল। ’

শুনে বুক কেঁপে ওঠে মমতার। ধপাস করে বসে পড়ে দরজার গোড়ায়। অসহায় ওর চোখের চাহনি। কণ্ঠে হতাশার সুর। একটা ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু এতো কিছু হবে, ভাবিনি। তাহলে এখন কী হবে বলো তো’!

মমতার মানসিক পরিস্থিতি লক্ষ্য করে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে অলকা। বলল, ‘কিচ্ছু হবে না মাসিমা। আপনি অযথা ভেঙে পড়ছেন। আমি বলছিলাম, কখন কী হয়, বিপদের কথা তো বলা যায় না! আর তাছাড়া, উজ্জ্বল বিদ্বান, বুদ্ধিমান, চালাকচতুর ছেলে। আর যাই হোক, অন্তত গায়ে এতোটুকু আঁচ পড়তে দেবে না। ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি, কাউকে পাঠিয়ে ওর খবর নেওয়া যায় কিনা’।

অলকা চলে যেতেই ভারাক্রান্ত মনটা খানিকটা হাল্কা হয় মমতার। চিন্তা-ভাবনাও খানিকটা দূরীভূত হয়। শারিরীক, মানসিক অবসন্নতা ঝেড়ে ফেলে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যথারীতিই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপরেও মনের মধ্যে একটা খটকা লাগছে। কোথায় যেন খুব হৈ চৈ হচ্ছে, চিৎকার চেঁচামিচি হচ্ছে শোনা যাচ্ছে। মমতা শোনে কান পেতে। কিন্তু শব্দটা তক্ষুণিই যেনো মিলিয়ে গেলো। ভাবল, হয়তো ওর মনের ভ্রম।

-‘দূর্গা, দূর্গা। সবই ভগবানের ইচ্ছা। ’ আপন মনে বিড় বিড় করতে করতে ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের কাজে।
                                                
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
এসএনএস 

** প্রতীক্ষা | যুথিকা বড়য়া (পর্ব-১)


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ