ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

অপয়া গিটার | সোহরাব সুমন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৮ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
অপয়া গিটার | সোহরাব সুমন অপয়া গিটার

কোথায় যেনো একটা সুর...। একটা রাগিনী, খুব করুণ সুরে একটানা বেজেই যাচ্ছে। সেই কখন থেকে! কিন্তু তাই বলে যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই? পুরো শহরে আজকে কি সবাই এই একটাই ইনস্ট্রুমেন্টাল বাজাচ্ছে। এও কী সম্ভব!

না, তা তো হতে পারে না। সুরটা আসলে আসছে আমার মাথার ভেতর থেকে।

খুবই করুণ। মন খারাপ করার মতো। কেন এমন হচ্ছে। এমন তো হবার কথা না। এই সুর তো আগে কখনও শুনিনি। মাথার ভেতর কি কোনো সুর তৈরি হতে পারে, আপনা আপনি? প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাচ্ছি। তাহলে আর অস্বীকার করা কেন। যেমন অস্বীকার করে আসছি তানসেনের মেঘমাল্লারের সুরে বৃষ্টি পড়ার কথা। তারপর তো এমন একটা ঘটনা চোখের সামনেই দেখলাম। ইমন ভাই যেদিন দুপুরবেলা আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে মিয়া-কি-মাল্লার বাজাচ্ছিলেন, তখন তো আকাশের কোথাও মেঘের কোনো লেশমাত্র ছিলো না। উনার এগারো তলার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে আমরা তখন বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।  
-এই যে দেখছ, জানালার বাইরে কী সুন্দর দৃশ্য, এর সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্টের সিনারির খুব একটা পার্থক্য নেই। বলতে গেলে হুবহু একই রকমের।
তারপর স্বগতোক্তি করার ভঙ্গিতে নিচু স্বরে বলে উঠলেন,
-ইস কতো মিল। অফ ডে-তে এই সময় আমি দুপুরের ভাত ঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার নেমে আসার পর অনেকক্ষণ পিলু ভাজতাম। একা একা। অন্য আর সবার কেমন বোধ হতো জানি না, সেখানকার বাইরের এই দৃশ্যপট বদল আমার কাছে তখন একই রকম লাগতো। প্রত্যেক দিন দেখা সম্ভব না হলেও, যেদিন বাজাতে বসতাম আর বাইরে তাকিয়ে থাকতাম কেবল সেদিনই বিষয়টা খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি। বা মাঝে মধ্যে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও। তবে তখন তো আর একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতাম না। দর্শক সারির মতন আমি বাজাবার সময় জানালার বাইরে তাকাই, অদৃশ্য এক দল সমঝদার রসিক শ্রোতার কল্পনা করি। যারা খুব বুঁদ হয়ে আমার গিটারে তোলা মৃদুমন্দ সুর শুনছে।  
-তাই বলে অদৃশ্য অডিয়েন্স! বাস্তব কোনো শ্রোতা দর্শক ছাড়া? রেকর্ড করে ফেললে হতো না।  
-তো। সমস্যা। এই তোমার মেটাফিজিক্স।  
-এটা আবার কী? কখন চর্চা করলাম। খুব অবাক হই। কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারি না।
-আচ্ছা, বাদ দাও, বাতাসে কী সব থেকে যায় না। শ্রোতারই-বা কী দরকার। তুমি যাই করবে সবই আসলে থেকে যাবে বুঝলে। তাই লোক দেখানো কিছু করবার বদলে মন দিয়ে চর্চা করে যাও। লেভেল। বুঝলে। একটা লেভেলে আসলে সবই ক্লিয়ার হয়ে যাবে। তখন বুঝবে। এর জন্য দরকার একাগ্রতা। অস্থির হলে চলবে না। হুটহাট কিছু করবে না। লেগে থাকো। এর বাইরে কিছু ভাবার দরকার নেই। সস্তা কোনো কথা কানে তুলবে না। শব্দব্রহ্মের কথা শোননি। বইটা যে নিয়েছিলে পুরোটা পড়ছ তো।
-হুম। পড়লাম। বাট কিচ্ছু বুঝিনি।  
-না বোঝার কী আছে?
-না, মানে তাইলে তো ধরতে হয়, তানসেন যে বৃষ্টি নামাতে পারতো কথাটা সত্য। বাট আপনি তো মনেন না।  
-এই সব ভুয়া, বুঝলে। আগেকার দিনের লোকেরা কথা ছড়াতে ওস্তাদ ছিলো। আর শোননি মানুষের ওপরেই তারা দেবত্ব আরোপ করতো। যা শুনতে পাওয়া যায় সব তো আর সত্য না। তাছাড়া তার রাজ দরবারে যাতায়াত ছিলো। আর রাজার চরেরা তাদের লোকেদের জনগণের কাছে ইমপর্টেন্ট করে তুলতে কতো কিছুই না করতো তার হিসেব আছে। সব তো আর সত্য না।  
-তাহলে গত বছর আপনি বরষার প্রথম পনের দিন দীপক বাজালেন তখন যে কোনো বৃষ্টি হলো না।
-চুপ চুপ, তুমি দেখছি গুজব ছড়িয়া ছাড়বে। এইসব কথা কারও সামনে বলবে না। বুঝলে। নাইলে হয় সবাই তোমাকে পাগল বলবে, নাইলে আমাকে। কালকে অতো রাতে ফোন দিয়েছিলে কেন বললে না। কী নিয়ে ভয় পেয়েছিলে বললে না।
মনে হয় ইমন ভাই প্রসঙ্গ বদলাতে চাইছেন। কোনো বিষয়ে কথা বলতে না চাইলে উনি এমনটা করেন। বা অন্য কিছুতে ব্যস্ত করে তোলেন যেনো আগের কথা আর মনে না থাকে। তখন কোনোভাবেই আর আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসা হয় না। এমনকি পরের বার নোট করে এসেও সে কথা আর উনার সামনে পাড়া যায় না, কিছুতেই।
-না, মানে সেদিন সকালে এসএমএস করলেন না, নোটগুলো। রাগের নাম তো ছিলো না। রাতের বেলা টুংটাং করতে গিয়ে খুব মজা পাচ্ছিলাম। কতোক্ষণ মনে নেই। হঠাৎ দেখি মাথার উপরে ছাদ নেই। বা অন্য কোনো খোলা জায়গাতে চলে গেছি। মাথার উপর কতোগুলো আগুনের গোলার দৌড়ঝাপ। চারপাশে অদ্ভুত সব তারার ভিড়। এক্কেবারে হাতের কাছে। মনে হয় হ্যালুসিনেশন। ভড়কায় গিয়েছিলাম। লাইট অন করতেই সব গায়েব। আচ্ছা টিজিএমটা কোথায় পেয়েছিলেন। আমাকে যে দিলেন সেটা। ওটাতেও কোনো সমস্যা থাকতে পারে। আমি পরীক্ষা করে দেখলাম।  
-বাহ্! দারুণ ডার্ক প্র্যাকটিস শুরু করেছ দেখি, কিন্তু পরীক্ষা সেটা আবার কী জিনিস, বলবে একটু বুঝিয়ে।  
-না মানে ঠিক পরীক্ষা না। ওয়ারড্রোবের উপর রাখি তো, শুইয়ে। কোথাও দাঁড় করিয়ে রাখলে তিতিন এসে ফেলে দেয় তো তাই। ও সারাদিন আমার রুমে দৌড়াদৌড়ি করে। আর টিজিএমটা নেওয়ার পর থেকে ওটার ভেতর কী যেনো একটা খোঁজে সারাদিন। কান খাড়া করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, ভেতরে থাবা চালাচালি করে। মাঝে মধ্যে গিটারটাতেও আজব আজব শব্দ হয় তখন। তারে টান লেগে এমন হয় বলতে পারেন। বাট আমি খেয়াল করে দেখেছি, ব্যপারটা আসলে তা না। যাই হোক, ওই যে গত সপ্তাহে জন এসে ভিজিটিং কার্ড দিলো না, ওটা বাসায় গিয়ে ওয়্যারড্রবের উপরে রেখেছিলাম। তারপর রাতে বাজানোর পর টিজিএমটা যখন রাখি কার্ডটা ওটার নিচে চাপা পড়েছিল। পরদিন তো দুপুর বারোটাও পার হয়নি। এককাপ চা হাতে টিভি ছাড়তেই স্ক্রলে দেখি ততক্ষণে মাইক্রো উল্টিয়ে ওরা সবাই হাসপাতালে। বাট মরে গেলো... কারণটা ঠিক বুঝলাম না। সন্দেহ হলেও তখনও কিন্তু সিউর ছিলাম না... 
-যাক, এইসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না। প্লেটোর একটা কথা বলেছিলাম মনে নেই। কাজেই ওই জগতের কিছু নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না, এই জগতের নলেজে টান পড়বো তোমার। বুঝলে। তাজ তো তোমার সঙ্গে বেয়াদবি করলো, ওর হাত পা একটাও আস্ত নেই। আর মিউজিক করা লাগবে না। আল্লার মাইর বুঝলে। যাক বেশি সমস্যা মনে করলে টিজিএমটা দিয়ে যেও। তোমারে এরপর একটা ইয়ামাহা দেবো। সেমি-অ্যাক্যুস্টিক। মনে হয়, বুঝলে, যে গাছের কাঠ দিয়া বানিয়েছে ওটার নিচে কোনো কবর ছিলো। রোজ উড না। কবরস্থানের গাছ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আর বিষ খেয়ে বা ফাঁসি দিয়ে মরে থাকলে তো কথাই নেই...! পরীক্ষার কথা কী যেনো বলছিলে?
-না মানে, তারপর আরও কয়টা ভিজিটিং কার্ড চাপা দিলাম। আমার তো তেমন কোনো শত্রু নেই তারপরও। ৠান্ডম। পরে তাদের সবারই কোনো না কোনো দুর্ঘটনার কথা জানতে পারলাম।  
-কী বলো! এটা তুমি যতো তাড়াতাড়ি পারো সরাও বাসা থেকে।  
-যাকে দেবে, খবরদার ভুলেও কিছু বলবে না!
-না, মানে এমন একটা জিনিস...। বলছিলাম আপনিই যদি ফিরিয়ে নিতেন। আফটার অল পুরা ব্যপারটা এখনও পর্যন্ত খুবই রহস্যময়। এমন ক্ষমতাও তো কারও হাতে তুলে দেওয়া যায় না।  
-না, অন্য কারও হাতে গেলে এমন নাও হতে পারে, আচ্ছা দেখা যাবে, আপাতত জিনিসটা আলাদা করে রাখো, কাউকে ধরতে দিও না। ঘর বন্ধ করে আসছো তো...
কথাগুলো বলতে বলতে ইমন ভাই কী যেনো ঘোরের মাঝে হারিয়ে গেলো, গিটার আর ধূসররঙা একটা পিক হাতে তুলে নিয়ে সোফায় বসে জানালার দিকে ফিরে আপন মনে বাজাতে শুরু করে দিলেন। এভাবে মিনিট পনের। তারপর হঠাৎ বাজাতে বাজাতেই বললেন।  
-এই নোটটা দেখ, ওঠার সময় জাস্ট এই যে একটা শার্প নোট, বেশ কিছুক্ষণ থাকতে হবে, বা ব্যাক করবে-ঠিক এই ভাবে, চলন বক্র, বুঝলে, আর অল্টার করে ক্রোমাটিকের সবগুলো নোট। তবে ফোরটির আগে পিলু ট্রাই না করাই ভালো। হয় না। ম্যাচ্যুরিটির একটা ব্যাপার আছে, বুঝলে। মনেও বসে না। কানেও না।  
ভেতর ভেতর আমার কেমন যেনো একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। সুরটা ঠিক ভালো লাগছিল না। অগোছালো মনে হচ্ছিল। এই জিনিস এতো পরিশ্রম করে তোলার কোনো মানে হয়। আর উনি কী কী নোট কম্বিনেশন দেখালো মাথায়ই ঢুকলো না। ক্রোমাটিকে বেছে বেছে এভাবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুর খোঁজা খুবই ঝামেলার। বেশিরভাগ সময়ই কিছু হয় না। তবে আমি যে এর আগে নিজে থেকে ট্রাই করে দেখেছি বহুবার সে ব্যপারে কিছু বলি না। হাবিজাবি নিয়ে কথা বাড়াতে আমার মোটেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। উনার সিক্স সেন্স খুব চাঙ্গা। তাছাড়া আমার মুখের ভাবভঙ্গিও বোধহয় স্পষ্ট ধরতে পারছিলেন। তাই মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই বোধ হয় বলে বসলেন।
-এই দেখ, এই নোটগুলা, স্রেফ এ-মাইনর, নেচারালের, বাট কম্বিনেশনটা ধরতে হবে... বইতে কিন্তু ভুল আছে, ওস্তাদরা এই জিনিস এত্তো সহজে আড়াইশো টাকার বইতে তুলে দিবে মনে করেছ, তাইলে কেউ যাবে না তাদের কাছে, এই দেখো এই ভাবে উঠবা সা রে মা পা ণি ধা নি সা... এই ক’য়টা নোট ব্যাস, এতেই নাকি তানসেন বৃষ্টি ঝরিয়েছিলেন। কী বুঝলে।  
বলে মৃদু হেসে আবারও গম্ভীর হয়ে বাইরের রোদেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এক মনে বাজাতে শুরু করলেন। সুরটা খুবই ভালো লাগছিল। কী যেনো একটা মাদকতা ছিলো। আমি নিজেও বুঁদ হয়ে গেলাম। কতোক্ষণ খেয়াল নেই। আকাশ ভেঙে যেনো অঝর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। রোদের মধ্যে মুশলধারে বৃষ্টি। আকাশের কোথাও মেঘের লেশ মাত্র নেই। এরই মধ্যে হঠাৎ চারপাশ সাদাটে হয়ে এলো। একেবারে ঘোলাটে। বড় বড় বৃষ্টি ফোঁটাগুলা রোদের আলোতে জ্বলজ্বল করছিল।
-দেখলে! এই বার কী বলবে। এই কথা কাওকে বললে করবে বিশ্বাস? আজকে হলো। টানা বিশ বছর ট্রাই করেছি, বুঝেছ, আরেক দিনও হয়েছিল, বাট তখন অতোটা খেয়াল করিনি, ভাবের মধ্যে ছিলাম। আজকে দেখলাম ভালো করে। তুমিও তো নিজের চোখেই দেখলে।  
যেনো প্রমাণ দেখাতেই বার কতোক থামালেন। আবার বাজানো ধরলেন। প্রতিবারই চোখের সামনে বৃষ্টির থামা, শুরু হওয়া, তাল আর লয় লক্ষ্য করলাম আমরা দু’জনেই। তারপর বাজাতে বাজাতে একসময় অন্য কোনো নোট কম্বিনেশনে বুঁদ হলেন। দেখতে দেখতে এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’জনেই একেবারে থ’!
-কোনোদিন দেখেছ, সবুজ এত্তবড় একটা চাঁদ, হুম? এই কথা কাওকে বিশ্বাস করাতে পারবে?
-রাগটা কী ছিলো ইমন ভাই, এখনকারটা!
বাইরে কলাপাতা রঙের সবুজ প্রকাণ্ড একটা চাঁদের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর অনেক্ষণ দু’জনের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। একসময় শোভা এসে ঘরে ঢুকবার পর আমরা কেউই আর চাঁদের দিকে খেয়াল করি না।  
না। করুণ সুরটা সন্ধ্যা বেলাতে মাথার ভেতরে আরও বেশি জেঁকে বসেছে। অনেকক্ষণ হয় মাগরিবের আজান শেষ হলো। এখন একটু শব্দ করে সুরটা ভাজতে কোনো অসুবিধা নেই। তাছাড়া চিলেকোঠার এদিকটাতে সন্ধ্যায় কেউ আসে না। এই সময়টাতে আমি এখানেই ভাঙা একটা কাঠের চেয়ারে বসে মাঝে মধ্যে গিটারে টুংটাং করি বা গুনগুন স্বরে গান গাই। কোনো কোনো দিন রাতে খাবার পর ভোর পর্যন্ত বসে থাকি। ইচ্ছে হলে গাই কখনও বা বাঁশিতে ফুঁ আনতে চেষ্টা করি। আজকে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ-ই সেই সুরটা ভাজতে শুরু করে দিই। সারাদিন মাথার ভেতর করুণ যে সুরটা ঘুরঘুর করছিল। আ-আ-আ। আ-আ-আ-আআআ...। দূরে, একটা বাড়ি পর চারতলার ছাদের ওপর আবছা একটা অবছায়া। বাতাসে কার যেনো চুল উড়ছে, এমন মনে হচ্ছে। গলা ছেড়ে গাওয়া সুরটা এখন চারপাশের আকাশে বাতাসে কী যেনো অজানা একটা মৌতাত ছড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে আকাশে আস্ত একটা সোনালি চাঁদ উঠল। চাঁদের আলোয় এতোক্ষণের সেই আবছা অবয়বটা আরও স্পষ্ট হলো। মনে হচ্ছিল গায়ে বুঝি একটা কাতান শাড়ি। লাল টকটকে, হবে হয় তো! পাড়জুড়ে সোনালি আভা না? কানে আর গলাতেও গয়নার একটা পড়ত রয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। নিভাকে ঠিক নিভার মতোই দেখতে লাগছিল। তবে আগেকার সেই বিভা আর না। সম্পূর্ণ নতুন কেউ। যেনো হঠাৎ-ই হাত তুলে কাউকে ডাকল। ওর গলার স্বরও শুনতে পেলাম। তবু আমি গিটার থেকে হাত সরাই না। বাজাতেই থাকি। কখন যে গলা ফুঁড়ে খুব মন খারাপ করা, অশুভ একটা সুর বেরিয়ে আসে। যেনো সুরটা কোনো ঘোর অমাবস্যার। কিন্তু আজ তো পূর্ণিমা। আকাশে সোনালি আস্ত একটা চাঁদ। তারপরও খুব অদ্ভুতভাবে আশপাশের আবহের সঙ্গে যেনো ভীষণ মানাচ্ছে। যেনো সেই সুরে অমাবস্যার রাতে ফোটে এমন সব ফুলেরা পাপড়ি মেলে ধরেছে। কাফনের মতো ধবল ফুলেদের গায়ে খুব অদ্ভুত হালকা একটা ঘ্রাণ থাকে। অবশ্য কথাটা আর কারও কাছ থেকে আমি শুনিনি। কিন্তু আমি সেই সুবাসহীন ধবল ফুলের ঘ্রাণ টের পাই। আশপাশে কোথাও হয়তো ফুটেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফুটে থাকা নিশাচর ফুলেদের ঘ্রাণ এটা। অমাবস্যায় ফোটা ফুলেদের ঘ্রাণ। ওরা যেনো আমার চারপাশে ঘ্রাণের আজব একটা বলয় তৈরি করেছে। সুরের টানে আমাকে ঘিরে ধরেছে অচেনা সেই ঘ্রাণের মৌতাত। তারপরও কেন যেনো গলা ধরে আসে। তবু থামা হয় না। গত বছর হেমন্তে এমন একটা সময়ে বিভার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর থেকে সামনা সামনি দেখা হয়নি আমাদের। তার বেশ ক’দিন পর ওর মা এসে আম্মার কাছে বিয়ের একটা কার্ডও দিয়ে যায়। কিন্তু সেই বিয়েতে বাসার কেউই যায়নি। আমার যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু বিয়ের আগের দিন গিফট দেওয়ার জন্য আব্বা প্যাকেট করা যে শাড়িটি আনে, আম্মা সেটা আমার ঘরে রেখে যায়। বিয়ের কার্ডসহ। আমি খুব সাহস করে বাক্সটা উল্টে শাড়িটা একপলক দেখি। ওর ওপরে রাখা চারকোনা এনভেলপে মোড়া পুরু সেই দাওয়াতের কার্ডটাও। ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাছিল-...পরিবারবর্গ। হাতের লেখাটা খুব চেনা। এরকম বাকানো হাতের লেখাতে ডজন ডজন চিঠি আমার ওয়্যারড্রবের ড্রয়ারে খুব যত্নে এখনও তোলা আছে। কার্ডটা এখনও আছে আমার রুমে। গত রাতেও একবার নেড়েচেড়ে দেখি। এতোদিন পর আর আগের মতো খারাপ লাগে না। বুকের ভেতর আগের মতন সেই হুহু ব্যথাটা আর হয় না। খয়েরি আর সোনালি পাড়। সোনালি অক্ষরে লেখা। খসখসে কয়েক পরত কাগজ। চাঁদের আলোয় ওর গায়ের শাড়িটাকেও সেরকমই খয়েরি দেখায়। পাড়টাও সেরকমই সোনালি। শাড়িটা পরে আম্মা আলমারিতে তুলে রেখেছিল। কার্ডটা আর নেয়নি। বোধ হয় আমাকে মেন্টাল পেইন দেওয়ার জন্যই খুব প্ল্যান করে... তবে প্ল্যানটা কার ছিলো পরে কখনই আর জানা হয়নি। কী জানি সবই আসলে বোঝার ভুল কিনা। নতুন শাড়ির একটা ঘ্রাণও নাকে এসে লাগে কথাগুলো ভাবার সময়। সঙ্গে অন্ধকারে ফোটা ধবল ফুলের মৌতাত। হেমন্তে এরকম ফুল আদৌ কোথাও ফোটে কিনা জানা নেই। হয় তো। কিন্তু সুরের অজানা একটা মায়ায় চারপাশটা কেমন যেনো ভারি হয়ে আসে। কেমন যেনো রহস্যময় একটা আবহ চারদিকে। দেখতে দেখতে চাঁদটা মাথার ওপর এসে ঠেকেছে। নিচ থেকে আম্মার ডাক শুনতেই সম্বিৎ ফিরে পাই। খাবার জন্য তাড়া দিতে আম্মা প্রায় ছাদের সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত উঠে আসতে যাচ্ছিল। ততোক্ষণে আমি জাম্বো অ্যাক্যুস্টিক গিটারটা বগলদাবা করে নেমে আসি। তাড়াহুড়া করে সেটা আগের জায়গায় রেখে হাত ধোবার জন্য খাবার টেবিলের পাশে কলাপাতা রঙের বেসিনের দিকে এগিয়ে যাই।  
পরদিন বিকেলে অয়ন এসে তড়িঘড়ি করে আমাকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায়। এক বছরের জুনিয়র হলেও, ও আমার অনেক দিনের বন্ধু। ওর হাতে মোড়ানো একটা খবরের কাগজ। কোনোরকম ভনিতা না করেই আমাকে জিজ্ঞেস করে।
-আজকে খবরের কাগজ পড়নি? 
-হেডলাইনগুলা শুধু। রাতে কী যেনো খারাপ একটা স্বপ্ন দেখলাম, এখন মনে কিছুই পড়ছে না। বিছানা ছাড়তে দেরি হয়। আব্বার হাতে পেপার ছিলো। আমি পাশ থেকে এক নজর দেখলাম। পড়া হয়নি। কে কী হয়েছে।
ও হাতে থাকা খবরের কাগজের প্রথম পাতাটা আমার সামনে মেলে ধরে।  
-নিভাকে মাটি দিয়ে এলাম, এই মাত্র। তুমি কী কিছুই জানো না।
প্রথম পাতার ওই ছবিটা আগেই দেখছি। রোজ এরকম কতো রকমই তো খবর আসে, কাগজের হেডলাইনে। আর দাঁত বের করা বিভৎস এরকম একটা ছবির সঙ্গে নিভার কোনো মিলই পাইনি তখন। কল্পনাও করিনি। অন্তত পেপারের একনজর ছবি দেখে কারও পক্ষেই তো এভাবে কাউকে চেনা সম্ভব নয়। আর আত্মহত্যার নিউজগুলা তো আমি সচরাচর খুব সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলি, খারাপ লাগে বলে। এমন পরিস্থিতিতে কী বলা যায় ভাবতে থাকি। অয়ন আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে।  
-এইটা কোনো আত্মহত্যা না বুঝতে পারছ! ওর জামাই একটা লুইচ্চা, বদমাইশ! 
ক্ষোভ না শোক কে জানে। কাগজটার দিকে আমি আর তাকাতে পারি না। কিছুই পড়া হয় না। গলা ধরে আসে। শুধু বলি।  
-শেষ দেখাটাও দেখতে দিলে না। আমারে একবার জানালে না! দরকার মনে করলে না!
ওকে বিদায় দিয়ে, শোবার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি ওয়্যারড্রবের ওপর শুইয়ে রাখা সেই অ্যাক্যুস্টিক গিটারের নিচে নিভার বিয়ের কার্ডটা চাপা পড়ে আছে, গত রাতে কখন যে কার্ডটা ওখানে রেখেছিলাম টেরই পাইনি। অপয়া গিটারটাও।  

বাংলাদেশ সময়: ১২০৬ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
এসএনএস                       
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ