ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

গল্প

হিসাবরক্ষণ | হানিফ মোল্লা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৭
হিসাবরক্ষণ | হানিফ মোল্লা ...

হাতে একটা ফুলতোলা লাঞ্চের ব্যাগ ঝুলিয়ে ভোরে বাসা থেকে বের হতে হয় রফিক সাহেবকে। পেশায় চাকুরে। পরিবারের ছোট ছেলে। ছাত্রজীবনে বন্ধুবান্ধব দুই/একজন থাকলেও চাকরি পাবার পর থেকেই কাজই তার একমাত্র বন্ধু। শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় আসেন অফিস করতে। প্রথমে পাঁচ মিনিট পায়ে হেঁটে গলির মোড়ে, সেখান থেকে রিকশা করে প্রধান সড়কে। এরপর চেপে বসেন পাঁচ নম্বর লোকাল বাসে। সেই বাসযাত্রা প্রায় এক ঘণ্টা কখনো বা তারও বেশি।

অফিসে সহকর্মীরা সবাই তাকে সম্মান করে। সেটা অবশ্য পদমর্যাদা বা ক্ষমতার জোরে না।

তার অগাধ সততাকে মনে মনে সবাই সম্মান করে। সুযোগের অভাবে সৎ কথাটা তার সাথে যায় না। তবে মানুষটা একটু ভীতু, ঠিক গুছিয়ে কোনো কথা বলতে পারেন না। হিসাবরক্ষণ বিভাগের প্রধান তিনি। যে কোম্পানিতে তিনি চাকরি করছেন তার নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা। লিমিটেড কোম্পানির মালিকপক্ষের দুই কর্তার সাথে রফিক সাহেবের যোগাযোগটা স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। হিসাবনিকেশ নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত তিনি নিজের টেবিলেই পড়ে থাকেন। অফিসের সবাই যখন ছ’টার পর বাসার পথ ধরে তখনো তিনি কোনো অভিযোগ বিহীন নিরলস কাজ করে যান। এই নিয়ে অনেকের খুঁতখুঁতি আছে। আর থাকবেই বা না কেন? অফিসের মাসিক মিটিংয়ে ডিরেক্টর স্যার যখন রফিক সাহেবকে উদাহরণ হিসেবে দেখায় যে, তিনি যদি রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করতে পারেন, অন্যসবাই কেন ছ’টার মধ্যে বাসায় যাবার জন্য ছটফট করে? এই প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা কিন্তু কেউ অফিসের বসের সাথে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ যুদ্ধে যেতে চায় না। ডিরেক্টর সাহেব নিজেও জানেন রফিক সাহেব একটু বেশি বোকা, তবু মালিকপক্ষের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে আর কর্মীদের আরো চাপে রাখতে এইসব কথা তিনি নিয়মিত মাসিক মিটিংয়ে বলে থাকেন।

আসল ঘটনা হলো গোটা অফিসে একমাত্র রফিক সাহেব অবিবাহিত। সংসারে তার কাজ তেমন কিছুই নাই। এখন অফিসের কাজকেই তিনি সংসার মনে করছেন কিনা তা বোঝা মুশকিল। তার জীবনে বিনোদন আছে বলে অন্য সহকর্মীরা বিশ্বাস করতে পারেন না। পান সিগারেটের অভ্যাস নাই। অফিসের রঙ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উপরোন্তু পিয়নকে জিজ্ঞেস করে চিনি কয় চামচ। তার টেবিলটা অফিসের এমন এক যায়গায় যে সেখান থেকে প্রায় সারা অফিসের চেহারাই দেখা যায়। মালিকপক্ষের সাথে তার যোগাযোগ এই মাত্রায় গেছে যে অন্য কেউ বুঝুক না বুঝুক বড় কর্তার রুমের বাইরের বেল বাজলে রফিক সাহেব কী করে যেন বুঝে যান যে তাকেই ডাকছে। অফিসের নতুন পিয়নরা এই দেখে তাজ্জব হয়ে যায়।  

বছর বছর পিয়ন আসে আবার চলে যায়। নানান লোকে চাকরি বদলায়, কিন্তু রফিক সাহেব কিসের টানে যে বিগত দশ বছর এই এক চেয়ারে কাটিয়ে দিলেন তা ঠিক করে কেউ বলতে পারে না। অফিসের হেড পিয়নের মারফত যতদূর জানা যায় যে প্রতি বছর মালিক পক্ষের নানান মিথ্যা আশ্বাস আর গাধার সামনে মূলা ঝুলানোর মতোই নানান রকম কথার বাজনা বাজায়। দু একমাস সেই সব মূলা নিয়ে রফিক সাহেব বড় সাহেবদের কাছে মাঝে মাঝে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে। এরপর কাজের চাপ আর নানান কারণে সেইসব ফিবছরের মতই চাপা পড়ে।
  
রফিক সাহেবকে অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে বড় কর্তার ড্রাইভার কেউই পছন্দ করেন না। সেটার একমাত্র কারণ টাকা পয়সা নিয়ে তার নানান রকম গোয়েন্দা তৎপরতা। আরে বেটা টাকা গেলে মালিকের যাবে, তোর বাপের তো যাচ্ছে না! কিন্তু রফিক সাহেব নিজে মালিক হলেও বোধহয় এতোটা কড়াকড়ি করতেন না। নাস্তার টাকার হিসেবটাও সে পাই পাই করে পিয়নের কাছ থেকে নেবে। গাড়ির ড্রাইভার কত টাকার গ্যাস নিয়েছে আর কত টাকার স্লিপ করছে সেটা নিয়েও তার আপত্তি। তার যতোটা সততা তার চেয়ে আনুগত্যতা বেশি। অফিসের এক কলিগ তো একবার কায়দা করে রাগ প্রকাশ করলো, হাসতে হাসতে বলেই ফেললো, আপনার মতো বিশ্বাসী কুকুর পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! কথাটা শুনে দুইদিন তার মন খারাপ থাকলো। মন খারাপ থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? পরের দিন স্টেশনারির বিল নিয়ে লেগে গেল এক পিয়নের সাথে।
কী ব্যাপার? কাগজের দাম এত বেশি কেন?
বেশি কই স্যার আগে তিনশ বিশ আছিলো এখন তিনশ পঞ্চাশ।
এক মাসে ত্রিশ টাকা বাড়ছে? কই স্লিপ দাও...
আগে থেকে বানানো খালি স্লিপে টাকার অঙ্ক পিয়ন যে নিজ হাতে বসায় সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। তারপরও রফিক সাহেব বলেন, ঠিক আছে তুমি স্লিপ রেখে যাও, আমি দোকানে গিয়ে চেক করে তারপর বিল দেবো। এখন যাও।  

পিয়নরা বেতন পায় আর কতো, দু’চার পয়সা একটু এদিক সেদিক করেই চলে। সেই জায়গাতেও রফিক সাহেব বাম হাত দেয়। বাম হাত বলাটাও অন্যায়, কারণ সে যা করে তা তো শেষ অবধি তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এইসব বাড়াবাড়ি রকম দায়িত্বের কারণে দিন দিন তিনি অফিসের সবার নীরব শত্রু হয়ে যান। অফিসে কারো কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে কলম আনতে হয় রফিক সাহেবের কাছ থেকে। আনতে গেলে রফিক সাহেব তার সামনে টেবিলে রাখা ডেস্ক ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে দেখেন যে, আগের কলম কয় তারিখে দেওয়া হয়েছে। যদি সেই ব্যক্তিকে কলম পনের দিনের মধ্যে আবার দিতে হয় তবে রফিক সাহেব মুখ কাচুমাচু করেন। এসবও হিসাবের মধ্যেই রাখেন তিনি। মোট কথা হিসাব বিষয়ক যতো রকমের বাড়াবাড়ি আছে তার সবই তিনি করেন। ডিরেক্টর সাহেবের বাণী তিনি মহাপুরুষের বাণীর মতই আওড়াতে থাকেন- দেখেন অফিস বাঁচলে, আমারা বাঁচব। তাই অফসের স্বার্থ সবার আগে।
  
মাঝখানে কিছুদিন রফিক সাহেবের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছিলো। একবার এক মেয়ে পক্ষের লোক অফিসে এসে রফিক সাহেবের খবর নিতে এলেন। এক জনকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার পর তার উত্তর ছিলো, এই আছে, খারাপ না। অথচ রফিক সাহেব দেখতে রীতিমতো সুদর্শন। তারপর রিসেপশনে রফিক সাহেবের সাথে বসে কথা বলার মাঝে পিয়ন তিন কাপ চা নিয়ে এলেন। তাতেই ঘটনা দফা রফা। পিয়নকে অতিথিদের সামনেই ধমক দিয়ে বসলেন, তুমি চা তিন কাপ কেন এনেছ? তোমরা কেবল অফিসের টাকা খরচ করে ফেলো। কতোবার বলছি দিনে দুইবারের বেশি চা কাউকেই দেবে না। আমাকেও না। এম ডি স্যারের কথা ভুলে গেছো? এতো বেশি হিসাবি ও আদর্শের বাড়াবাড়িতেই কিনা কে জানে সে যাত্রায় তার সেই বিয়েটাও আর হলো না।
 
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। ডিরেক্টর সাহেবের হঠাৎ করে কয়েকটা ফ্ল্যাট আর শহরের মাঝে দামি কয়েকটা জমি কেনার খবর কী করে যেন তার আরেক পার্টনারের কানে চলে গেছে তা বোঝা মুশকিল। হঠাৎ হেড অফিস থেকে কোন নোটিশ ছাড়াই অডিট টিম চলে এলো। দুই তিন দিন বিস্তর কাগজপত্র ঘেঁটে লেনদেনে বড় রকম সব ঘাপলা বের হলো। অফিসের সবার ভেতর এই নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। সবাই প্রথমে অবাক হলেও জানে এই কাজ রফিক সাহেবের পক্ষে করা সম্ভব না। ডিরেক্টর স্যার যে তার পার্টনারকে ঠকায় সেটা অফিসের সবাই বুঝতে পারে। কিন্তু এতো বড় রকমের জালিয়াতি কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ঘটনা হলো বছর দুয়েক ধরে ডিরেক্টর সাহেব রফিক সাহেবকে দিয়ে প্রায় জোর করে হিসেবে বড় রকমের সব গরমিল করে রেখেছেন। রফিক সাহেব অডিট টিমের কাছে কেবল বলতে পারলেন– স্যারকে জিজ্ঞেস করেন। আমি স্যারের কথামতো এসব করেছি। আর কোথায় কখন কত টাকা জমা দেয়া আর তোলা হয়েছে তার হিসাব আছে আমার কাছে। কিন্তু অফিসের টাকা আর মালিকের ব্যাক্তিগত একাউন্ট যে এক জিনিসে না সেটা পাগলেও বোঝে। ক্যাশ ভাউচার আর ব্যাংক রসিদে কেবল রফিক সাহেবের সাইন।

ডিরেক্টর সাহেব প্রথমে অডিট টিমকে ঘটনার সত্যতা জানালেন কিন্তু পরে তাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে চাইলেন। কিন্তু কার কপাল খারাপ কে জানে? তারা রাজি হলেন না এবং সেই রিপোর্ট চলে গেলো অন্য পার্টনারের হাতে। স্বাভাবিকভাবে যা হবার তাই হলো। প্রথমে দুজনে ঝগড়া, তারপর একদিন মিটিংয়ের নামে দুজন দুজনকে গালাগালির পর মামলা হয়ে গেলো। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলেও বরাবরের মতোই মামলার আসামি করা হলো রফিক সাহেবকেই। অবাক হবার কিছু নেই। একদিন দুপুর বেলা জোহর নামাজ পড়ে রফিক সাহেব তার লাঞ্চ বের করছেন মাত্র। দু এক গ্রাস মুখে দিলেন এমন সময় পিয়ন এসে বললো-
স্যার থানা থেকে পুলিশ আসছে। আপনারে খোঁজে? রফিক সাহেব ভেবেছিলো তাকে সেই সব ঝামেলা নিয়ে প্রশ্ন করবে বড়জোর। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পুলিশ হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। অপমানে তার মুখ পাথরের মতো হয়ে গেলো। তিনি একবার শুধু বলতে চাইলেন, আমার কী দোষ? পিয়ন ছেলেটি যে কিনা রোজ পাঁচ দশ টাকা নিয়ে রফিক সাহেবের সাথে ভেজালে জড়ায় সে দৌড়ে গিয়ে বড় স্যারের রুমে গিয়ে খবরটা জানায়। বড় কর্তা তখন ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। রিসিভার নামিয়ে কথাটা শুনেই পিয়নকে একটা কড়া ধমক দিলেন, বাইর হ! সেই শব্দ রফিক সাহেবের কান পর্যন্ত এসে গেলো। অফিসের নিচে চায়ের দোকানের লোকজন আর ভিখেরিরা রফিক সাহেবের দিকে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছেন। মাথা নিচু অবস্থায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে পুলিশ ভ্যানে ওঠানো হলো।

কোন রকম আপসরফা ছাড়াই রফিক সাহেবকে থানায় চালান করে দিলো। জল গড়িয়ে অনেক দূর যাবার আগেই রফিক সাহেবের বড় ভাই শফিক অনেক ঘাটের জল খেয়ে একজন উকিল ঠিক করলেন। কিন্তু মামলার প্রথমদিন দুই পক্ষের উকিলের জেরা শেষে এজলাশ থেকে যখন বিচারক প্রথমে মালিককে জিজ্ঞেস করলেন তার বক্তব্য- সোজা সরল উত্তর- আমি এই ব্যাপারে অডিটের আগে কিছুই জানতাম না। তারপর রফিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কী বলার আছে? রফিক সাহেব দুবার জিজ্ঞেস করার পরো কোন উত্তর দিলো না। কান দিয়ে সেই কথা ঢুকল বলে মনে হলো না। আকাশ ভেঙে পড়ার মতো করে তার মনের ভেতর যেন গোটা একটা সমুদ্র তার সব জল নিয়ে ঢুকে পড়েছে। নিজের জিহ্বাটা নাড়ানোর শক্তিটাও তার এখন নাই। দুই চোখ দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে কেবল চারপাশে তাকিয়ে আছে। শরীরের শক্তি বেকার হয়ে পড়ে, যখন মানুষ তার মনের জোর বা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সাত পাঁচে বারো হিসেব যে মিলাতো সেই মানুষটা এখন আরেকজনের সাত পাঁচের প্যাচে পড়ে বোবা হয়ে গেছে একদম।  

সেদিন জামিন হলো না। জালিয়াতির মামলা বলে কথা। শফিক সাহেব কেবল ভাইয়ের কাছে বারবার বলে গেল, ভাই চিন্তা করিস না, পরের তারিখেই আমি জামিন নিয়ে নেবো। শফিক সাহেবের সাথে তার ছোট ছেলেটা আসছে তার চাচাকে দেখতে। এই ছেলেটাই ছুটির দিনে রফিক সাহেবের সাথে ঘুরে বেড়াতো আর মাঝে মাঝে রাতে চাচার সাথে থাকার বায়না করতো। বাচ্চাদের স্বভাব হলো তারা যার কাছে আদর পাবে তার কাছেই যাবে। ভাতিজাকে দেখে একবার কেবল রফিক সাহেবের মুখে কথা ফুটলো। তাও এক শব্দ। বাচ্চা ছেলেটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কান্না জড়িত গলার একবার কেবল বলল- বাবা!

পরের তারিখ যে কবে সেটা শফিক সাহেব নিজেই জানে না। দেশে আদালতের যা অবস্থা, কমসে কম মাস দুয়েক যে লাগবে সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। প্রথম দিন জেল হাজতে তাকে ঢোকাতে হলো টেনেহিঁচড়ে। এ কারণে পুলিশের চড়, থাপর আর বুটের লাথি খেয়ে আরো নির্বিকার হয়ে গেলো রফিক সাহেব। সেখানে অনেকের সাথে গাদাগাদি করে থাকতে দেয়া হলো। বেশিরভাগ আসামি দাগী, আর সেলের মধ্যে বিড়ির গন্ধে একবার দুবার মূর্ছাও গেলো। সেটা কেউ টের পেলো না। না খেলে মারা যাবার ভয় ছিলো কিনা জানি না তবে যতটুকু খেলে বেঁচে থাকা যায় তার বেশি তার মুখে উঠলো না এই হাজত বাসের দিনগুলোতে।
আড়াই মাস পর আবার মামলা এজলাসে উঠলো। রফিক সাহেবকে চেনা যাচ্ছে না। তার ভাইয়ের ছেলে যে কিনা প্রায় রাতে চাচার সাথে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যেতো সেও তার বাবাকে বললো- বাবা চাচা কই? 

দাড়ি গোঁফ আর চুলের ভাজে তাকে সাধু পুরুষের মতো দেখতে এখন। চালাক চতুর উকিল প্রথম বারের চেষ্টায় না পারলেও এইবার তার জামিন হয়ে গেলো। ঘরে ফিরে রফিক সাহেব এইবার এক নতুন দুনিয়ার মুখোমুখি হলো। রাস্তায় হাঁটতে বের হতে পারে না। লোকজন তাকে দেখলেই ফুসুর ফাসুর করে কথা বলে। কি বলে সেটা রফিক সাহেব ঠিক আন্দাজ করতে পারেন। পাশের বাসার এমএ ফাইনাল ইয়ারের মেয়েটা যে কিনা তাকে দেখলে মাথা নিচু করে মুচকি হাসতো সেও এখন কপাল কুঁচকে হন হন করে বাতাসে একটা ঘৃণা ছড়িয়ে চলে যায়। ঘর বাহির তার কাছে আরেক দম বন্ধ জেলখানা মনে হতে থাকে। মনে মনে তিনি ভাবেন জেলখানা তাও ভালো- কেউ হয়তো ভালোবাসে না কিন্তু কেউ ঘৃণাও তো করে না। সেখানে সবাই সমান, সবাই আসামি।

মোটা অঙ্কের মাইনে পেত বলে যে ভাবী তাকে খাতির করতো, একদিন রাতে সেই ভাবীই বড় ভাইয়ের সাথে কী যেন কথা কাটাকাটির কারণে চিৎকার করে বলেই ফেললো- তুমি তো চোরের ভাই। তুমি আর কতো ভালো হবা। ভদ্র লোকদের সংসারে ঝগড়ার এক দুই বাক্য পাশের বাড়ির মানুষের কানে যায়, বাকি ঝগড়া তারা চুপে চাপে চিবিয়ে চাবিয়ে চাপা গলায় চালিয়ে যায়। সেটা ভদ্রতার একটা হাস্যকর ম্যানার। কিন্তু কথাটা রফিক সাহেবের কান পর্যন্ত গেলো। সেদিন সারারাত তার ঘুম হলো না।
 
পরদিন সকালে তিনি তার আগের জীবনের মতো করে শোয়া থেকে উঠলেন। ঘুম নাই তাই চোখ টকটকে লাল। বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ গোসল দিলেন। পুরাতন জং ধরা রেজর দিয়ে গোঁফ দাড়ি কাটলেন। গলির মোড়ের হোটেলটায় নান রুটি আর মুগডাল দিয়ে নাস্তা করলেন। সময় নিয়ে এক কাপ চা খেতে খেতে কী যেন ভাবলেন। পেটে খাবার পড়াতে মাথাটা কাজ শুরু করলো বোধহয়। তারপর একটা গোল্ডলিফ সিগারেট খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে টেনে মাথাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তার মুখে এখন অচেনা একটা তৃপ্তির চাপা হাসি। মনে মনে কিছু একটা হিসেব তিনি মিলিয়ে ফেলেছেন।

পাঁচ নম্বর বাসে চড়ে তিনি তার পুরাতন অফিসে চলে গেলেন। রিসিপশনের রোগা সাদা মেয়েটা তাকে দেখে অবাক হয়ে চোখ বড় করে কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলো। বড় সাহেবের রুমের বেলটা বেজে উঠতেই রফিক সাহেব কাউকে কিছু না বলে তার রুমে ঢুকে গেলো। বড় সাহেব কিছু বোঝার আগেই রফিক সাহেব চোখের ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো- কেমন আছেন স্যার? তারপর একটা বল পয়েন্ট কলম স্যারের ঠিক গলার নরম জায়গাটায় নির্ভুল বসিয়ে দিলেন। সে কলম রক্তসহ ঘাড়ের দিকে বের হয়ে গেছে। বেল বাজার কারণে পিয়ন এসে দেখলো বড় সাহেব ফাঁস খাওয়া লোকের মতো টেবিলের পাশে কার্পেটে পা ছুড়ছেন আর দুই হাত দিয়ে রফিক সাহেবের একটা পা ধরে আছেন। তার বুকের উপরে একটা পা দিয়ে রফিক সাহেব স্বাভাবিক গলায় বলে যাচ্ছেন- হিসেব পাইছেন স্যার? হিসেব মিলছে স্যার?

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৭
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ