ঢাকা: পাঁচ পাঁচবার বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল বরাবরই বিশ্বসেরা। সৃজনশীল অতুলনীয় ফুটবল খেলায় পটু ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের তাই জুড়ি মেলে না কখনোই।
তাই তো ব্রাজিল বন্দনা। এ বন্দনা শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ‘ফুটবল ঈশ্বর’ পেলে যে ব্রাজিলের বাসিন্দা, ফুটবলপ্রিয় মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই সেই ব্রাজিলকে সমর্থন করা উচিত বলে মনে করেন দেশের অগণিত ব্রাজিল সমর্থক।
তাদের মতে দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ মানে তো এক অর্থে ব্রাজিলই!
আর এর প্রমাণ গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে দাঁত ভাঙা ভঙ্গিতেই দিয়ে দিয়েছে পেলে-ভাবা-তোস্টাও-গারিঞ্চা-জিকো-রোমারিও’র উত্তরসূরীরা।
এ খেলায় ফুটবলকে দু’হাত ভরে পুষিয়ে দিয়েছে ব্রাজিল, বিশ্বসেরাদের মতোই ব্রাজিল খেলে; ক্যামেরুনকে ৪-১ এ চুরমার করেছে। এর আগে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে ওচোয়ার এক অতিমানবীয় খেলায় মেক্সিকোর সঙ্গে ড্র করে স্কলারির ছাত্ররা। তার আগে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া প্রথম ম্যাচে ২ গোল করে সাও পাওলো কাঁপিয়েছিলেন আধুনিক ফুটবলের জনক নেইমার। আর ফলাফল ব্রাজিল ৩-১ গোল ব্যবধানে জয়ী।
সবচেয়ে বড় কথা এবারের বিশ্বকাপে (সর্বশেষ অবস্থান অনুযায়ী) ২২ বছর বয়সী নেইমার সর্বোচ্চ গোলের একক মালিক। নেইমার ও তার বয়স নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, যারা আশঙ্কা করেছিলেন গত বিশ্বকাপের মেসির মতো পরিণতি হয় কিনা, তারও সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে দিয়েছেন নেইমার।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ছাত্র ফারাবি। দিন রাত ফুটবল নিয়ে ভাবনা।
তার মতে, ব্রাজিল মানে ফুটবল, আর বাকি দুনিয়া শুধুই ব্যক্তিগত পছন্দ!
ফারাবি তো শুধুই এক ব্রাজিল সমর্থকের উপমা। তার মতো এমন কোটি ব্রাজিল সমর্থক রয়েছেন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে।
যুব সমাজ, কি বয়বৃদ্ধ অথবা কি তরুণী কি বৃদ্ধা। দেশের অধিকাংশ মানুষই ভেদাভেদহীনভাবে ব্রাজিলের সমর্থক। আর তাই তো সারা দেশব্যাপী প্রতিটি বাড়ির ছাদে ব্রাজিলের পতাকার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
আর জার্সি বিক্রির দিক দিয়েও যে কোনো মহারথীর চেয়ে এগিয়ে ব্রাজিলই।
ব্রাজিল সমর্থকদের মতে, ব্রাজিলের সঙ্গে চলে না আর্জেন্টিনা কিংবা কারোরই তুলনা! কেননা আমাদের দেশে ব্রাজিলের সঙ্গে বিশেষ করে তুলনা জুড়ে দেওয়া হয় আর্জেন্টিনার। ব্রাজিল পাঁচবার বিশ্বকাপ বিজয়ী আর আর্জেন্টিনা মাত্র দু'বার।
ব্রাজিল সমর্থকরা মনে করেন, ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার ফারাক আসলে এখানেই।
প্রতিবেশী দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। তবে এ দু’দলের ফারাক যেন যোযন যোযন।
তর্কের খাতিরে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা বলা হয় প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে বিশ্বকাপ জয়ে ব্রাজিলের ধারেকাছেও নেই তারা। সে হিসেবে ব্রাজিলের পরেই বিশ্বকাপ জয়ের দিক দিয়ে নাম রয়েছে ইতালির। তারা বিশ্বকাপ জিতেছে মোট চারবার। আর রানারআপ হয়েছে মোট দুইবার।
এরপরেই রয়েছে হিটলারের দেশ জার্মানি। তারা বিশ্বকাপ জয় করেছে তিন বার, হয়েছে সমান রানারআপও। তাহলে এখন প্রশ্ন, কেনো তুলনা করা হয় ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার?
পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে আর্জেন্টিনা দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছে। তার একটিতে আবার রয়েছে বিতর্কেরও ছাপ। ৮৬'র বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার হাত দিয়ে গোল বির্তক আজও বেশ তীব্র। তবে সম্পূর্ণ নিট অ্যান্ড ক্লিন ও পাওয়ার ফুটবলের দেশ উরুগুয়েও পেয়েছে আর্জেন্টিনার সমান সংখ্যক বিশ্বকাপ শিরোপা। তাই আরেকটি প্রশ্ন, কেনো উরুগুয়ে আর্জেন্টিনার কাতারে নয়?
এবার খেলার দিকে নজর দেওয়া যাক, ব্রাজিল দলে এবার রয়েছেন আধুনিক ফুটবলের শ্রেষ্ঠ তারকা নেইমার। ধারাবাহিক ভালো ফলাফলের প্রতিমূর্তি তিনি। আর এবারের বিশ্বকাপে ৩ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৪ গোলের মালিক।
মাত্র বাইশ বছর বয়সে যার তুলনা ফুটবল বিশ্বে তিনি নিজেই। নেইমারের আরেকটি গুণ, তিনি তার ফুটবল ক্যারিয়ারে লাল কার্ড পেয়েছেন এমন নজির নেই।
রয়েছেন দক্ষ গোলরক্ষক জেফারসন ও জুলিয়ো সেজার। যাদের হাত ফসকে বল জালে যাওয়া আর পৃথিবীতে কদাচিত সূর্য গ্রহণ হওয়া এক কথা!
ব্রাজিল দলে আরো রয়েছেন বিশ্বসেরা ডিফেন্ডার দালি আলভেস, থিয়াগো সিলভা, দাভিদ লুইচ, মাক্সওয়েল, মার্সেলো, দান্তে, এনরিকে ও মাইকন। যারা খেলেন এক কথায় অনবদ্য।
মিডফিল্ডারদের মধ্যেও রয়েছেন ব্রাজিলে বিশ্বসেরাদের ছড়াছড়ি। এরমধ্যে অস্কার, পাউলিনিয়ো, ফের্নান্দিনিয়ো, রমিরেস, লুইজ গুস্তাবো, এর্নানেস, উইলিয়ান, বের্নার্দ।
ফরোয়ার্ডে রয়েছেন ফ্রেদ, হাল্ক ও জো। যার নিজেই নিজেদের নাম প্রতি সুবিচারের যোগ্য।
সুতরাং তারকা খ্যাতির দিক দিয়েও আর্জেন্টিনার সঙ্গে তুলনা করতে নারাজ ব্রাজিল সমর্থকরা।
তাদের মতে, আর্জেন্টিনার শুধু মেসিছাড়া তারকা খ্যাতি আছে এমন ফুটবলারের সংখ্যা হাতে গোনা।
এর মধ্যে গোলরক্ষক রোমেরো, গোনসালো হিগুয়েইন, রোদ্রিগেস ছাড়া আর নাম খুঁজে পাওয়াই নাকি ভার। তার ওপর আবার মেসি লীগ খেলায় যত না উজ্জ্বল, জাতীয় দলের হয়ে ঠিক ততটাই মলিন।
ঠিক তেমনি ব্রাজিল নয়; গোটা ফুটবল বিশ্বে সময়ের সেরা তারকা নেইমার লীগ খেলায়ও যেমন দুর্দান্ত ঠিক তেমনি জাতীয় দলের হয়েও সমান অংশীদারিত্বশীল। যার প্রমাণ জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ থেকেই দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
আরও একটি কারণকে ব্রাজিল সমর্থক বাঙালি বড় করে দেখছে। আর তা হলো ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জার্সিতে বাংলাদেশের নাম 'মেইড ইন বাংলাদেশ' থাকা।
পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা এবার নিজ দেশের জার্সির কলারের ট্যাগে বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের জন্য এক বিরল সম্মান 'মেইড ইন বাংলাদেশ'। এই বিষয়টিকেও অনেক ব্রাজিল সমর্থক সামনে তুলে এনেছেন।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে দেশের গার্মেন্ট থেকে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার মুনাফা এসেছে ফুটবল বিশ্বে জার্সি রপ্তানি করে। বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনাতেও গেছে জার্সি। তবে মেইড ইন বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়নি তারা।
বাস্তব অর্থে এখানেও তুলনা চলে না ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার, বলছেন অনেকেই।
আর একটি যে বিষয় রয়েছে তা হলো, ব্রাজিলের দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। সর্বাধিক বিশ্বকাপের মালিকদের দেশে তাদের আধিপত্য খাকবে এটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং আধিপত্যের দিক দিয়েও চলে না ব্রাজিলের সঙ্গে কারো তুলনা।
তাই তো ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে হয়, এক দেশ, এক কাপ, এক নেইমার এবং ষষ্ঠ শিরোপা। এই দিক দিয়েও ব্রাজিলই এগিয়ে।
সেই সঙ্গে ব্রাজিলের এক ৬ আঙুলের পরিবারেরও যে ব্রাজিলের ষষ্ঠ শিরোপা ভাগ্যের উপমা সে দিক দিয়েও এগিয়ে ব্রাজিল।
এবার নিজ মাটিতে আসলেই বিশ্বকাপ-২০১৪ জিতে নিতে পারে পেলে-ভাবা-তোস্টাও-গারিঞ্চা-জিকো-রোমারিও'র দেশ। কেননা এর অন্যতম ফেভারিটদের তালিকায় তারাই যে সবার চেয়ে এগিয়ে।
দেশটির চিরচেনা হলুদ-সবুজ জার্সিতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ কোটি বাঙালি ও বিশ্ববাসীর সমর্থন।
তাই তো চাওয়া, এবার দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জিতে নিক পেলে-ভাবা-তোস্টাও-গারিঞ্চা-জিকো-রোমারিওর দেশ, সাম্বা-নৃত্যে মাতোয়ারা ফুটবল-উন্মাদনার দেশ, আধুনিক ফুটবলের তীর্থ ও সৃজনশীল ফুটবলের মালিক ব্রাজিলই।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৪