ডাচ এরোস্পেইস কোম্পানি মানে হল্যান্ডের মহাকাশ সংস্থা নাকি ঘোষণা দিয়েছে এবার বিশ্বকাপ জিততে পারলে হল্যান্ড দলকে তারা মহাকাশে বেড়াতে পাঠাবে! ওদের এই চমকদার ঘোষণাটা মনে হয় ভালোভাবেই মনে ধরে গেছে ডাচ দলের। তাই বুঝি এমন একটা প্রায়-অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললো তারা চোখের পলকে!
মেক্সিকোর বিপক্ষে ফলাফল যখন হল্যান্ড ০,মেক্সিকো ১ ; - খেলা শেষ হতে মিনিট দুই বাকি ,কি কাণ্ডটাই না করলো কমলা জার্সির চিরচেনা এই দল।
দর্শক গ্যালারিতে দৃষ্টিনন্দন "মেক্সিকান ওয়েভ" হয়তো চলবেই প্রতিদিন কিন্তু তাতে অংশ নেবেনা খোদ মেক্সিকানরাই ! কারণ মাঠে তো আর থাকছেনা মেক্সিকো।
হল্যান্ড দলের এই জয় আর কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া অবশ্য মোটেও কাকতালীয় না। যোগ্যতর দল হিশেবেই ম্যাচটা জিতে নিয়েছে তারা। যে দলের ভালো খেলার ইতিহাস এত বছরের, আধুনিক টোটাল ফুটবলের অন্যতম পথিকৃৎ যে দল , গত বিশ্বকাপের ফাইনালিস্টও যে দল, এই আসরের প্রথম রাউন্ডে নৈপুণ্যবিচারে যে দলটি ছিলো প্রশ্নাতীত সেরা -সেই দলের এই জয় মোটেওতো অস্বাভাবিক না। তবু কিছু মানুষ কেন যে মেক্সিকোকে বেটার টিম ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলেন খেলা চলার সময় তা আমার বোধগম্য নয়। এই খেলায় যদি হল্যান্ড হেরে যেত তাহলে কি তা অঘটন হিশেবে দেখা হতোনা ?
গতকালের এই খেলায় হল্যান্ডের সবচে' বড় বাধা ছিলো তাপমাত্রা। প্রায় ৩৯ ডিগ্রি সেলশিয়াস টেম্পারেচার মানে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মেক্সিকোর খেলার অভ্যাস আছে, হল্যান্ডের নেই। তাপমাত্রা এমন থাকবে জানা ছিলো বলে ডাচ কোচ আগে থেকেই অস্বস্থি আর দুশ্চিন্তায় ছিলেন কি করে তার দল স্বাভাবিক খেলা খেলবে -এই নিয়ে ।
তিনি ফিফাকে অনুরোধও করে রেখেছিলেন যাতে ড্রিঙ্কস ব্রেক দেওয়া হয় খেলা চলাকালীন । শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো 'কুলিং ব্রেক' বা পানি বিরতিপর্ব দেখা গেল দুই অর্ধে দুইবার । ফিফাপ্রদত্ত এই কুলিং ব্রেক অনেকটাই স্বস্থি দিয়েছিলো খেলোয়াড়দের কিন্তু অসহ্য গরম সারা খেলাতেই ছিলো একটা ফ্যাক্টর । যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তাদের পারফরম্যান্সে ।
হল্যান্ডের ভয় ছিলো ওচোয়াকে নিয়ে । ইতিমধ্যে সবার নজরকাড়া এই মেক্সিকান গোলরক্ষক ভাল খেললেও টিকতে পারেননি শেষপর্যন্ত, ডাচ প্লেয়ারদের পারফেক্ট শুটিঙের কাছে। ৮৮ মিনিটে মেক্সিকোর জালে স্নেইডারের পাঠানো কামানের গোলার মতো শটটা কোনোভাবেই ঠেকানোর উপায় ছিলোনা ওচোয়ার। পরের মানে হল্যান্ডের জয়সূচক গোলটা তো ছিলো পেনাল্টি থেকে । পেনাল্টি কিকে গোল খাওয়া তো আর গোলকিপারের ডিসক্রেডিট না ।
অনেকেই কথা তুলছেন এই পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে। রেফারি নাকি না দিলেও পারতেন এটি । কথা সত্যি । না দিলেও পারতেন রেফারি। কিন্তু 'না দিলেও পারতেন' আর 'সিদ্ধান্তটা ভুল ছিলো' - এক কথা না। গোলসীমানায়, ৮ গজ এলাকার এত কাছে এমন ফাউল করলে তাতো পেনাল্টি হবেই। মেক্সিকান ডিফেন্ডার মারকুয়েজ ডাচ স্ট্রাইকার আরিয়েন রবেনকে ট্যাকল করতে গিয়ে তার অ্যাংকেলে পায়ের চাপ দিয়ে যেভাবে ফেলে দিয়েছেন তা মাঝমাঠে হলে হয়তো রেফারির বাঁশি বেজে উঠতোনা।
ফাউলের এলাকাটা যেহেতু ফুটবলের ভাষায় 'বিপজ্জনক এলাকা' -রেফারির চোখে পড়লে তা থেকে বাঁচার উপায় নেই । তবে অতীতে অনেক খেলায় এমন ঘটনায় রেফারির এড়িয়ে যাওয়া দেখে অনেক দর্শক ভেবেছিলেন এটিও পেনাল্টি ছিলোনা ।
কেউ কেউ এটি যে পেনাল্টি ছিলো না প্রমান করতে মিগুয়েল হেরেরা'র উদ্ধৃতি দিতে পারেন । হেরেরা তো খোদ মেক্সিকোর কোচ । তিনিতো রাগে-ক্ষোভে বলতেই পারেন ,রেফারি হারিয়েছে মেক্সিকোকে। তাছাড়া , সাইড লাইনে এই কোচের লাফঝাঁপ ,নাচানাচি ,চ্যাঁচামেচি... সবই ছিলো এই বিশ্বকাপের অন্যতম হাইলাইট। এবারে ৩২ দলের কোচদের মধ্যে সবচাইতে কম বেতনপাওয়া এই কোচ গত কিছুদিন নিয়ম কানুন ভুলে যেসব আচরন করছিলেন সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে তার মুখে রেফারিকে নিয়ে এমন উক্তি মোটেও বেমানান না ।
এই খেলায় হল্যান্ডের জন্য আরেকটি আতঙ্কের নাম ছিলো দোস সান্তোস । মেক্সিকান এই জনপ্রিয় স্ট্রাইকার খেলার প্রথম গোলটা করে ঠিকই কাজের কাজ করে ফেলেছিলেন কিন্তু ৬০ মিনিটে কেন যে তাকে উঠিয়ে বদলী খেলোয়াড় মাঠে পাঠালেন হেরেরা তা বোঝা যায়নি। কোচ কি তবে ধরে নিয়েছিলেন দলের জয় নিশ্চিত, কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য সান্তোসকে তুলে রাখা দরকার ?
দিনের শেষ অর্থাৎ পরের নক আউটে মুখোমুখি হয়েছিলো দুই আন্ডারডগ কোস্টারিকা, গ্রিস। এক কথায় শুরু থেকে 'বোরিং' এই খেলাটা নাটকীয়ভাবে শেষ হবে তা বোঝার উপায়ই ছিলোনা। ১-০ ব্যবধানে কোস্টারিকার জয় যখন প্রায় নিশ্চিত তখনি কিনা গ্রিসের গোল। গোলটা হয় নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পরের মিনিটে ,ইনজুরি টাইমে। তারপর জমে ওঠা খেলাটা টাইব্রেকারে গড়ায়। যাতে আর টিকতে পারেনি বিশ্বকাপে প্রথমবার দ্বিতীয় রাউন্ডে ঊঠা গ্রিস। এই খেলায় জিতে মাঝারি শক্তির কলম্বিয়া গিয়ে পড়বে শক্তিশালী হল্যান্ডের সামনে। আগামী শনিবার, শেষ কোয়ার্টার ফাইনালে।
লেখার শুরুতে বলছিলাম না ডাচ এরোস্পেস কোম্পানির ঘোষণার কথা ! ঘোষনাটা সত্যি তবে তা খুব সম্ভবত দলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। তা কি বাস্তবে সম্ভব ? বিশ্বকাপ জিততে পারলে নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড়রা হয়তো ঐ কোম্পানিকে কোনোদিন বলতেও যাবেননা , মঙ্গলগ্রহে পাঠান আমাদের! তার দরকারও পড়বেনা। কারণ ফুটবলের বিশ্বকাপ জিততে পারে যে দল সে দলের তো চাওয়ার কিছু বাকি থাকেনা আর!তাহলে দেখাই যাক কতদূর যেতে পারে পাতালপুরীর দেশ নেদারল্যান্ডস।
বাংলাদেশের আধুনিক স্পোর্টস সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মনে করা হয় তাকে। বর্তমানে কানাডার মন্ট্রিয়লে থাকেন। তবে এখনও স্পোর্টস এবং লেখালেখি তার হ্রদস্পন্দনের সাথেই যেনো মিশে আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের এবারের আয়োজনে ফরহাদ টিটো লিখছেন বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৪