১৯৯১ সালে দিয়েগো ম্যারাডোনা যখন নাপোলি ছেড়ে সেভিয়াতে পাড়ি জমান, ক্লাবটি তার সম্মানার্থে ১০ নম্বর জার্সিটি আজীবনের জন্য উঠিয়ে নেয়। এরপর আর কোনো নাপোলি খেলোয়াড়ের গায়ে দেখা যায়নি এই জার্সি।
দিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবর জানার পর প্রথমবারের মতো ঘরের মাঠ 'স্তাদিও সান পাওলো'য় খেলতে নেমেছিল নাপোলি। আবেগ সংবরণ করে খেলতে নামা দলটির খেলোয়াড়রা সবাই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির ট্রেডমার্ক ১০ নম্বর জার্সি পরে মাঠে নামেন। পরের ম্যাচের আগে হয়তো এই মাঠের নামও বদলে যাবে। যে মাঠে একসময় সদর্পে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ম্যারাডোনা, এখন তার নামে হচ্ছে 'স্তাদিও দিয়াগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। '
বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) রাতে ইউরোপা লিগের ম্যাচে রিজেকার মুখোমুখি হয়েছিল নাপোলি। খেলা শুরুর আগে ম্যারাডোনার প্রতি সম্মান জানাতে দুই দলের খেলোয়াড়রা এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। ম্যাচটি ২-০ গোলে জিতে তা ম্যারাডোনার স্মৃতির প্রতি উৎসর্গও করে দলটি।
ইতালির নেপলস শহরটা এখন প্রিয়জন হারানোর শোকে কাতর। হাজারো ভক্ত অঝোরে কাঁদছেন পিয়াজ্জার বিশ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ম্যারাডোনার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ হাতে ফুল ও মোমবাতি জ্বালিয়ে হাজির নাপোলির স্টেডিয়ামের সামনে। কারো হাতে ম্যারাডোনার ছবি সম্বলিত ব্যানার, পতাকা। সমর্থকরা পুরো স্টেডিয়াম অনেকটা সময় রিং বানিয়ে ঘিরে রাখেন।
করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রিয় দলের খেলা দেখতে মাঠে যেতে পারেননি সমর্থকরা। মাঠে ঢুকতে পারলে হয়তো সমর্থকদের বিলাপে আকাশ কেঁপে উঠতো। কারণ স্টেডিয়ামের সামনে হাজারো সমর্থক জড়ো হয়ে সমস্বরে 'ফুটবলের রাজা, নাপোলির রাজা, তুমি আর নেই' গাইতে থাকেন। রাস্তায় প্রজেক্টর বসিয়ে ম্যারাডোনার ফুটবল জীবনের নানান কীর্তি দেখানোও চলে অনেকক্ষণ।
রীতি অনুযায়ী, নাপোলি সমর্থকরা প্রিয় দল জিতলে লা ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে দেন। কিন্তু এদিন সমর্থকরা সেটা ভুলেই গিয়েছিলেন। তবে এক অশীতিপর বৃদ্ধা বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আকাশটা লাল ধোঁয়ায় ঢেকে দেওয়ার আহ্বান জানানোর পর চিত্র পাল্টে গেল। গোটা আকাশ যেন মুহূর্তেই ভালোবাসার রং লালে রাঙিয়ে দিলেন সমর্থকরা।
অন্তত ক্লাব ফুটবলের ক্ষেত্রে এই নাপোলিতে পাওয়া সাফল্যকেই আর্জেন্টাইন কিংদবন্তির সেরা সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুধু কি তাই, ইতালিয়ান ক্লাবটির ইতিহাসেও ম্যারাডোনার সময়কালকে বলা হয় স্বর্ণযুগ। বার্সেলোনার মতো ইউরোপের বনেদি ক্লাব ছেড়ে যখন নাপোলির মতো প্রায় অখ্যাত এক ক্লাবে নাম লেখালেন অনেকে নাক ছিটকানো শুরু করেছিল। কিন্তু আভিজাত্য ও ঐতিহ্য না থাকা এক ক্লাবের সমর্থকদের তাদের ইতিহাসের সেরা সময় উপহার দিয়ে যান ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনার প্রতি নাপোলির সমর্থকদের ভালোবাসা আসলে এককথায় অকল্পনীয়। ইতালির নেপলসের এই ক্লাব শুধু নয়, পুরো শহরের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন আত্মার আত্মীয়। ম্যারাডোনা নামের মহাতারকা ফুটবলার তাদের ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তার বিপ্লবী চরিত্রে মুগ্ধ হয়েছিলেন নেপলসের মানুষ। আদতে ইতালিয়ান ফুটবলে বিপ্লব এনেছিলেন ম্যারাডোনা। শূন্য থেকে শুরু করে ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাবের তকমা এনে দিয়েছিলেন নাপোলিকে। ভেঙে দিয়েছিলেন এসি মিলান, ইন্টার মিলান, জুভেন্টাস এবং রোমার মতো জায়ান্টদের আধিপত্য।
১৯৮৪ সালের ৫ জুলাই ম্যারাডোনা যখন সেসময়ের রেকর্ড ৭ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি'তে আনুষ্ঠানিকভাবে নাপোলিতে পা রাখলেন, তাকে স্বাগত জানাতে স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন ৭৫ হাজার দর্শক। ক্রীড়া লেখক ডেভিড গোল্ডব্লাট ওই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, 'তারা (সমর্থকরা) বুঝে গিয়েছিলেন ত্রাণকর্তা এসে গেছে। ' এমনকি স্থানীয় এক সংবাদপত্র এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, 'আমাদের মেয়র, বাড়ি, স্কুল, বাস, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্যা রয়েছে, তবে এগুলো কোনো মুখ্য বিষয় নয়। কারণ আমাদের কাছে ম্যারাডোনা আছে। '
নাপোলির সমর্থকদের সেই ভরসার প্রতিদান দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। তার নেতৃত্বে ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম ইতালিয়ান সিরি আ'র শিরোপা জেতে দলটি। এই শিরোপা জয়ের আনন্দে পড়ে কয়েক মাস উৎসব করেছে নেপলসবাসী। ওই সময় শহরের প্রাচীন ভবনগুলোতে ম্যারাডোনার অসংখ্য ছবি আঁকা হয়েছিল। এমনকি নবজাতক সন্তানের নাম তার নামে নামকরণের ধূম পড়ে যায়। এরপর ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে আরও একবার লিগ শিরোপা জেতে নাপোলি। পরবর্তীতে ক্লাব ছাড়ার পর তার সম্মানে ১০ নম্বর জার্সিকে আজীবনের জন্য অবসরে পাঠায় ক্লাবটি। শুধু কি তাই, আজও সমর্থকদের একাংশ তার নামে চার্চ স্থাপন করে আরাধনা করেন।
ক্লাবের মহানায়ককে শেষ বিদায়টাও আবেগের ফুল সাজিয়েই দিলেন নাপোলির সমর্থকরা। ক্লাবের মালিক ও নেপলসের মেয়র জানিয়ে দিলেন, নাপোলির স্টেডিয়ামের নাম ম্যারাডোনার নামে করা হবে। সমর্থকরা স্টেডিয়ামের বাইরে বিশাল এক ব্যানার টানিয়ে দিলেন। যাতে লেখা 'দ্য কিং'। রাস্তায় হাজারো পোস্টারে লেখা- ম্যারাডোনা, নেপলস আজ কাঁদছে। '
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২০
এমএইচএম