সদ্যই বার্সেলোনার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে লিওনেল মেসির। কাতালান জায়ান্টদের পক্ষ থেকে কারণ হিসেবে লা লিগার আর্থিক নিয়মের বেড়াজালের কথা জানানো হলেও সমর্থকরা তা কিছুতেই মানতে পারছেন না।
গতকাল বৃহস্পতিবার পুরো ফুটবলবিশ্বকে চমকে দিয়ে বার্সেলোনা জানিয়ে দিয়েছে, মেসির সঙ্গে নতুন চুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। যদিও মেসি বেতন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে রাজি ছিলেন। এমনকি চুক্তি নবায়নের সম্ভাবনার কথা শুনে ক্যাম্প ন্যুতে উৎসবের আমেজও বিরাজ করছিল। শোনা যাচ্ছিল ৫ বছরের নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন তিনি। এরপর এই সপ্তাহেই জুভেন্টাসের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে মাঠে নামার কথা ছিল তার। কিন্তু সবকিছু এক লহমায় বদলে গেল।
মধ্যরাতে জানা গেল, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সত্ত্বেও লা লিগার আর্থিক নীতির কারণে চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব নয়। ফলে ১৭ বছরে বার্সাকে ৩০টি শিরোপা জেতানো মেসি ক্যাম্প ন্যু থেকে বিদায় নিচ্ছেন। ক্লাবের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়ের এমন বিদায়ে মুষড়ে পড়েছেন বার্সাভক্তরা। প্রথমে চমকে যাওয়া, পরে অবিশ্বাস এবং শেষে হৃদয়ভাঙার কষ্ট। এই হচ্ছে বার্সা সমর্থকদের অবস্থা।
এক বছর আগেও ক্যাম্প ন্যুর বাইরে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো মেসিভক্ত। তখন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড নিজেই ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেবার চুক্তির শর্তের কারণে না হলেও এবার বিচ্ছেদ ঠেকানো গেল না। অথচ মেসি এখন ফ্রি এজেন্ট। ফলে সমর্থকরা ধরেই নিয়েছেন এবারের ব্যর্থতার দায় ক্লাব প্রেসিডেন্টের। বর্তমান বার্সা প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তা দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই বলে আসছিলেন, মেসিকে ধরে রাখার সব ব্যবস্থা পাকা। গত জুনে যখন মেসির চুক্তির মেয়াদ শেষ হলো তারপরও তিনি একই কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু তার পক্ষেও ক্লাবের কিংবদন্তিকে ধরে রাখা সম্ভব হলো না।
এর আগে মেসিকে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করা ম্যানচেস্টার সিটি ও পিএসজি মূলত বার্সা প্রেসিডেন্টের আত্মবিশ্বাসের কারণেই দূরে সরে গিয়েছিল। এরইমধ্যে সিটিজেনরা ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে ইংলিশ মিডফিল্ডার জ্যাক গ্রিলিশকে কিনেছে। পিএসজিও সার্জিও রামোস, জিয়ানলুইজি দিনারুমা, জর্জিনিয়ো উইনালদাম এবং আশরাফ হাকিমিকে দলে ভিড়িয়ে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। তবে এখন এই দুই ক্লাবই ফের মেসিকে কেনার দৌড়ে এগিয়ে আছে।
পরিস্থিতি অনুযায়ী, মেসিকে এরপর হয়তো ক্যাম্প ন্যুয়ে পিএসজি কিংবা সিটির জার্সিতে দেখা যেতে পারে। এমনকি ক্লাবের সবচেয়ে সফল খেলোয়াড় হয়েও করোনা এবং আর্থিক জটিলতার কারণে স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের সামনে প্রাপ্য বিদায়টাও নেওয়া হচ্ছে না তার। বিষয়টা হজম করা বার্সা ও মেসি ভক্তদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এজন্যই তারা দলে দলে ক্যাম্প ন্যুর বাইরে জড়ো হয়ে ‘আমরা সত্য জানতে চাই’, ‘মেসিকে যেতে দিও না’ এমন সব স্লোগান দিচ্ছেন।
তবে বার্সা প্রেসিডেন্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তারা মেসিকে ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। মেসির পছন্দ অনুযায়ী তার প্রিয় বন্ধু ও আর্জেন্টাইন সতীর্থ সার্জিঅ আগুয়েরোকে দলে ভিড়িয়েছে তারা। কিন্তু সব ঠিকঠাক থাকলেও লা লিগার নীতির কারণে হার মানতে হয় তাদের। তারপরও চুক্তি সম্পন্ন করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতো। এমনকি আইনি ঝামেলাতেও পড়তে হতো।
এর আগেই লা লিগার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাস জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘মেসির জন্য নিয়ম বদলানো সম্ভব নয়। এর আগে রোনালদো ও নেইমারের বিদায়ে আর্থিক ধাক্কা সত্ত্বেও তাদের অবস্থানের বদল হয়নি। ফলে মেসির বিদায়ও খুব বড় কোনও প্রভাব ফেলবে না বলে জানান তিনি। বার্সার হাতেও আর উপায় ছিল না। কারণ মেম্ফিস ডিপে, আগুয়েরোদের কিনে আনার পর আর্থিক জটিলতার কারণে নিবন্ধন করতে পারছিল না তারা। মেসি চলে যাওয়ায় সেই পথ পরিস্কার হলো।
ভক্তরা যতোই কষ্ট পান না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে মেসির পক্ষে আর বার্সার খেলোয়াড় হিসেবে থাকার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি বার্সার লিজেন্ড, আইডল, ছয়বারের ব্যালন ডি’অরজয়ী, ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা (৬৭২), ১০বারের লা লিগাজয়ী, চারবারের চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী এবং ২১ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড গড়ে আসা খেলোয়াড় হতে পারেন। কিন্তু বার্সার ইতিহাসে কিংবদন্তিদের বিদায় দুঃখজনকই হয়। এখানে যুক্তির কোনও স্থান নেই।
গত আগস্টেই চলে যেতে চেয়েছিলেন মেসি। কিন্তু পরে আরও কয়েক মাস তাকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। এরপর ২০২১ সালে নিজের সেরা ফর্মে ফেরেন তিনি। সদ্যই কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতার স্বাদ নিয়েই ফিরেছিলেন নতুন চুক্তি করতে। কিন্তু হলো ঠিক উল্টোটা। গতবার তবু ধাক্কা খেলেছিল সমর্থকরা, কিন্তু তা অনেক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে তাদের মনে, কারণ এবার ঘটনা যে সত্য! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বার্সা কি নিজেদের ভুলেই এই বিপদে পড়েছে?
অধিকাংশ সমর্থকদের মতে, এটা সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মারিয়া বার্তমেউর কারণে হয়েছে। আবার অনেকের মতে, এটা লা লিগার দায়। কারণে তারা লিগের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়কে ধরে রাখতে কোনও ভুমিকাই পালন করেনি। তবে কেউ কেউ এখনও দাবি করছেন, এটা লাপোর্তার দাবার চাল। মেসির বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে আসলে লা লিগা প্রেসিডেন্ট তেবাসকে চাপে ফেলে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করতে চান তিনি। তাদের বিশ্বাস, লা লিগা তার সেরা খেলোয়াড়কে কিছুতেই হারাতে চাইবে না। ফলে সমর্থকরা ‘আসল সত্য’ জানতে চান।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০২১
এমএইচএম