ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পেরিয়ে অর্থাৎ ১৮৬০ সাল থেকে ফুটবলের প্রসার ঘটে উরুগুয়ের মন্টেভিডিও, ব্রাজিলের সান্তোস, রিও ডি জেনেরিও ও আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের সমুদ্রবন্দরের ব্রিটিশ নাবিকদের কল্যাণে। জাহাজিরা পণ্য ওঠানামা করার অবসরে চামড়ার বলে লাথি মেরে সময় কাটাত।
প্যারাগুয়ের সীমান্তে আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কোরিয়েন্তেস নদীর অববাহিকায় ইন্ডিয়ান আদিবাসী ‘গুয়ারিনি’ গোত্র। স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে ওই অঞ্চলে তাদের বসবাস। কলোনিয়াল যুগের আধুনিক সমৃদ্ধি তাদের জীবনযাত্রার মানে খুব একটা হেরফের ঘটায়নি। সুঠাম স্বাস্থ্যের সুবাদের ভারী জিনিসপত্র বয়ে নেওয়া মানে কুলিগিরি ছাড়াও অন্যান্য শারীরিক পরিশ্রমের কাজের জন্য তাদের ডাক পড়ত।
সেই গোত্রে জন্ম নেন চিতোরো, ডিয়েগো ম্যারাডোনার বাবা। জীবনের শুরুতে কোরিয়েন্তেস নদীর পারে নিজ গোত্রের মধ্যে গত্বাঁধা জীবন কাটালেও ইউরোপীয়দের আমদানি করা ফুটবল ছিল তাঁর অন্যতম নেশা। তুলার বস্তা কাঁধে নিতে গিয়ে একবার বুকের পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙে গেলে বেকার হয়ে পড়েন চিতোরো। হাতে কাজ না পেলে তখন বেরিয়ে পড়তেন পূর্বপুরুষদের মতো কাঠের ক্যানু ভাসিয়ে মাছ ধরতে। পাশাপাশি বনে-জঙ্গলে হরিণ, আর্মান্ডিলা ও সাপ শিকার ছিল জীবনধারণের অন্যতম ভরসা।
প্রতি রবিবার ছুটির দিনে ছোট ভাই চিরিলোকে সঙ্গে নিয়ে ভরপুর মদ খেয়ে দাপিয়ে ফুটবল খেলতেন। তবে ফুটবলার হিসেবে সুনাম বেশি কুড়িয়েছিলেন চিরিলো। ১৯৫২ সালে স্থানীয় স্যান মার্টিন ফুটবল দলের হয়ে ঘরোয়া লিগে চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাপ-চাচার এই ফুটবলের ধারাটাই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে ম্যারাডোনার পায়ে। সেটা কখনো সবুজ ঘাসের ক্যানভাসে পেয়েছে শিল্পিত রূপ, কখনো বা ‘হ্যান্ড অব গডে’ চমকে গেছে ফুটবলবিশ্ব।
ম্যারাডোনার নানি সালভাদোরা করিয়োলচি ছিলেন দক্ষিণ ইতালি থেকে আসা অভিবাসী দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মাত্র ১৭ বছর বয়সে জন্ম দেন ‘অবৈধ’ কন্যাসন্তান। নাম রাখলেন ডোনা তোতা। ২১ বছর বয়সে তোতা চলে যান রাজধানী বুয়েনস এইরেসে নতুন জীবনের সন্ধানে। কাজ নেন ধনীর বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে। এরপর চিতোরোকে নিয়ে আসেন বাড়তি আয়ের আশায়।
তোতার আগ্রহে নদী অববাহিকার বুনো জীবন ছেড়ে হঠাৎ করে বুয়েনস এইরেসের ইট-পাথরের জঙ্গলে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিল চিতোরোর। কিছুদিন কুলিগিরি করে পরে কাজ নেন বাসস্থান ভিলা ফিয়োরতিওর কাছে এক গরুর হাড় গুঁড়া করার কারখানায়। দমবন্ধ করা পূতিময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হতো চিতোরোদের মতো শ্রমিকের দৈনিক ১২ ঘণ্টা। পরবর্তী সময়ে পুত্র ম্যারাডোনা বিখ্যাত না হলে হয়তো অন্যান্য শ্রমিকের মতো চিতোরো অনেক আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন ফুসফুসের ক্যান্সার বা দূষণজনিত অন্য কোনো রোগে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্জেন্টিনার হাল ধরেন জেনারেল হুয়ান পেরন। মুসোলিনি ও হিটলারের ভক্ত তিনি। রক্ষিতা হিসেবে পরিচিত হলেও পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা পাওয়া এভিটা পেরন ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সহচর। এভিটা নিজেও এসেছেন দরিদ্র অবহেলিত পরিবেশ থেকে। সেই সূত্রে সবাই স্বপ্ন দেখত, তারাও একদিন এভিটার মতো আর্জেন্টিনার সম্রাজ্ঞী হবেন।
তোতা নিজেও এজাতীয় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। পেরন-এভিটা জুটি জাতীয়তাবাদ ও সাম্যবাদের দোহাই তুলে গরিবদের চোখে ঠুলি পরিয়ে জনগণের হাতে তুলে দিলেন নতুন আফিম—‘ফুটবল’। নব্য জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে নতুন আবেগের অস্ত্র হিসেবে ফুটবলকে নতুন করে বেছে নিল আর্জেন্টিনার জনগণ। ফুটবলেই যেন দেশের যাবতীয় সমস্যার একমাত্র মুক্তি। কমবেশি একই অবস্থা তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে।
তৃতীয় জন্মদিনে ম্যারাডোনা ছোট চাচা চিরিলোর কাছ থেকে জীবনের প্রথম উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন চামড়ার ফুটবল। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ওটাই ছিল ডিয়েগোর একমাত্র সঙ্গী। চিতোরো তখন কাজ করেন স্থানীয় ফল বিক্রেতার কুলি হিসেবে। কিন্তু ছোট্ট ডিয়েগোকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেন আকাশকুসুম। পুরো বস্তি চত্বরে শিশু ম্যারাডোনা খলখলিয়ে সেই ফুটবল পায়ে দৌড়ে বেড়ান। তোতা প্রশ্রয় দেন। লেখাপড়া করার দরকার নেই। প্রেসিডেন্ট পেরনের আর্জেন্টিনায় ফুটবল খেলে নাম করতে পারলে সব দুঃখ ঘুচে যাবে। শৈশবে ম্যারাডোনা তাঁর বাবা-মায়ের স্বপ্নকে আরো উসকে দিতে বড় শপথ করেছিলেন। বলেছিলেন, বড় হয়ে তিনি প্রিয় দল বোকা জুনিয়রে যোগ দেওয়া ছাড়াও আরেকটি স্বপ্ন দেখেন, আর্জেন্টিনার জন্য বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে আনা।
অনেকে এটাকে বস্তির ছেলের মামুলি স্বপ্ন হিসেবে কথার কথা ধরে নিলেও ডোনা তোতা যেন জানতেন তাঁর ছেলে ঠিক পারবে। ব্রাজিলের নান্দনিক কিংবদন্তি রোনালদিনহো তাঁর আইডল ম্যারাডোনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জানান, “আমি বল নিয়ে যত কিছুই করি না কেন ম্যারাডোনার মতো কমলা লেবু পায়ে নিয়ে ‘কিপি-আপি’ করতে পারব না। ”
স্প্যানিশ ফুটবলের ইতিহাসে মাত্র দুজন খেলোয়াড় প্রতিপক্ষ মাদ্রিদের বিপক্ষে গোল করেও বিপুলভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে এই দুর্লভ সম্মান পাওয়া একজন হচ্ছেন বার্সেলোনার হয়ে খেলা রোনালদিনহো আর অন্যজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। খেলোয়াড় হিসেবে এই অনুভূতি ফুটবল ক্যারিয়ারে সেরা স্বীকৃতির মধ্যে অন্যতম, তা দুজনেই স্বীকার করেছেন।
তবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে ম্যারাডোনার মতো এত স্পষ্ট ও ঠোঁটকাটা কোনো ফুটবলার সম্ভবত আর নেই। ম্যারাডোনা একবার বলেছিলেন, ‘মা বলেছেন আমি পেলের চেয়ে ভালো ফুটবলার। আমি নিজেও তা বিশ্বাস করি। কারণ আমার মা কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। ’ ফিফার জরিপেও তা-ই দেখা গেছে। এই গৌরব নিয়ে ফুটবলের এই আমুদে চরিত্রটি পৃথিবীকে বিদায় বলেছেন ঠিক এক বছর আগে। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় তার। কিন্তু ফুটবল কিংবদন্তির অশরীরী উপস্থিতি যে আরো প্রবল হয়ে ফিরছে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০২১
এমএমএস