আর্জেন্টিনার রোজারিওতে ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন হোর্হে হোসারিও মেসি এবং সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনির ঘর আলো করে এলো এক ছোট শিশু। নাম লিওনেল মেসি।
১৩ বছর বয়সেই বার্সেলোনার যুব অ্যাকাডেমি লা মেসিয়ায় প্রশিক্ষণের সুযোগ পান মেসি। রত্ন চিনতে ভুল করেনি বার্সেলোনা। একটি টিস্যু পেপারেই তার সঙ্গে চুক্তি করে নেয় স্পেনের ক্লাবটি। মেসির গ্রোথ হরমোনের সমস্যা থাকলেও তার সম্পূর্ণ চিকিৎসা খরচ নিজেদের করে নেয় বার্সেলোনা। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বার্সেলোনার হয়ে মাঠে নামেন মেসি। এর পর পুরো ফুটবলবিশ্ব বুঁদ হয়ে দেখেছে এই ফুটবল জাদুকরের জাদু। মাঠের সবুজ ঘাস যেন মেসির ক্যানভাস। একে একে এঁকে গেছেন দারুণ সব শিল্পকর্ম। ফুটবলবিশ্ব মুগ্ধ হয়ে দেখেছে সেসব। ক্লাব ফুটবলের সব সাফল্যই একে একে কুর্নিশ করল মেসিকে। ক্লাবের হয়ে সম্ভাব্য সব শিরোপাই জিতলেন ফুটবল জাদুকর। ব্যক্তিগত পর্যায়ের সব পুরস্কারও শোভা পায় মেসির কেবিনেটে। সবাইকে ছাড়িয়ে ব্যালন ডি’অর জিতলেন ছয়টি।
এর পরও অপূর্ণতা এই আর্জেন্টাইন রাজপুত্রের! আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্ট এলেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মেসি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখতেন ক্লাব ফুটবলের সব কিছুই জয় করা মেসি। যেখানে ক্লাব ক্যারিয়ারে পরিপূর্ণতায় ভরা, সেখানে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নেই কোনো শিরোপা। মেসির মধুর ক্যারিয়ারে এই একটিই অপ্রাপ্তির সুর ছিল। একটি আন্তর্জাতিক শিরোপার আক্ষেপ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল আর্জেন্টাইন ফুটবল যাদুকরকে। তবে দেনাটা যেন মেসির নয়। মেসির কাছে ফুটবলের। ফুটবলকে তো কম কিছু দেননি তিনি। কতশত ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মতো মুহূর্ত দিয়েছেন। তবে কেন মেসিকে আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপাবঞ্চিত রাখবে ফুটবল দেবতা?
মেসির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পর্তুগিজ যুবরাজ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরও ছিল আন্তর্জাতিক শিরোপার আক্ষেপ। তবে মেসির আগেই ইউরোর শিরোপা জিতে সেই শাপমোচন করেছেন রোনালদো। এর পর যেন নিন্দুকের সমালোচনার বাণ আরও তীক্ষ্ণভাবে বিদ্ধ করতে লাগল মেসিকে। সব সমালোচনা মুখ বুজেই সয়ে গেছেন তিনি। মেজাজ হারাননি। বরং জবাব দিতে চেয়েছেন মাঠের পারফরম্যান্সে।
অবশেষে সমালোচনার জবাব দিলেন মেসি। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকায় নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে দুঃখ ঘোচালেন ফুটবলের এই দুঃখী রাজপুত্র। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা উঁচিয়ে ধরলেন তিনি। এর চাইতে ভালোভাবে হয়তো মেসির দেনা শোধ করতে পারত না ফুটবল দেবতা।
তবে এক বিন্দুতে এসে মিলে যায় সময়ের দুই সেরা ফুটবলার মেসি-রোনালদোর সমর্থক থেকে শুরু করে সমালোচকরা। একটি বিশ্বকাপের আক্ষেপ সময়ের সেরা দুই ফুটবলারের। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে তো সোনার হরিণের দেখা পেয়েই ফেলেছিলেন আর্জেন্টাইন রাজপুত্র। দলকে টেনে নিলেন ফাইনালে; দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সবাইকে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন আরও একবার। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস। শেষ মুহূর্তের গোলে বিশ্বকাপ শিরোপা অধরাই রয়ে গেল। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার মেসির হাতে উঠলেও মেসির চোখ ছিল সেই সোনার হরিণের দিকেই।
সমালোচকদের জবাব দিতে ২০১৫ ও ২০১৬ দুই মৌসুমে কোপা আমেরিকার ফাইনালে দলকে টেনে তুললেন মেসি। কিন্তু দুঃখ ঘুচল না দুঃখী রাজপুত্রের। আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতা হলো না। ফুটবল ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়তো ভিন্ন ছিল, দুবারই কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলির কাছে হেরে রানার্সআপ হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে মেসির আর্জেন্টিনাকে। মেসি-রোনালদোর পর ফুটবলে বড় তারকা হিসেবে বিবেচনা করা হয় নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পেকে। এমবাপ্পের নামের পাশেও শোভা পায় বিশ্বকাপ জয়ের তকমা। মেসির প্রতি সমালোচকরা একসময় এতটাই নির্দয় হয়ে উঠেছিলেন যে অবসরের পথেই হেঁটেছিলেন তিনি। তবে অবসর ভেঙ্গে ফিরে আসলেন মেসি। জয় করলেন কোপা আমেরিকার শিরোপা। এবার পালার বিশ্বকাপ জয়ের।
এবারই নিজের বিশ্বকাপ জয়ের শেষ সুযোগ দেখছেন মেসি নিজেও। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘হয় এবার, নয় কখনোই না। এটাকেই আমাদের শেষ সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। আমরা যদি শিরোপা জয়ের এটাই শেষ সুযোগ ভেবে মাঠে নামি আমরা শিরোপা নিয়েই মাঠ ছাড়তে পারবো। ’
আগামী বিশ্বকাপে মেসির বয়স হবে ৩৯ বছর। অনুমিত ভাবেই তখন বিশ্বকাপে দেখা যাবে না এই ফুটবল জাদুকরকে। ৩৫ বছর বয়েসি মেসির এটাই শেষ সুযোগ বিশ্বকাপ জেতার। তবে এভাবে না বলে যদি বলা হয় মেসির প্রতি ঋন শোধ করার এটাই শেষ সুযোগ ফুটবলের তা খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না হয়তো। কারণ বিশ্ব ফুটবলকে মেসি যা উপহার দিয়েছেন তার জন্য একটি বিশ্বকাপ ফুটবলের কাছেই পাওনা তিনি।
ফুটবল দেবতা নাকি কারও পাওনা মেটাতে বিমুখ হন না! এই যেমন বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই অসাধারণ ফুটবল উপহার দিয়ে আসা স্পেনের প্রাপ্য মিটিয়েছেন ২০০৮ ইউরো, ২০১০ বিশ্বকাপ আর ২০১২ ইউরোর শিরোপা উপহার দিয়ে। ম্যারাডোনার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারকে পূর্ণতা দিয়েছেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মুকুট পরিয়ে।
এই ফুটবলেই আবার প্রাপ্য বাকি থেকে যাওয়ার গল্পও আছে। ইউসেবিও আর ইয়োহান ক্রুইফের কখনো বিশ্বকাপ না-জেতা তো তা-ই বলে। আবার ডি স্টেফানো বা জর্জ বেস্টের মতো ফুটবলারদের কখনো বিশ্বকাপ খেলতে না পারাটাকেই-বা কী বলবেন! এসব হিসাব টেনেই হয়তো ২০০৮ সালে অলিম্পিক সোনাজয়ী মেসির সাবেক সতীর্থ অস্কার উসতারি বলেছেন, ‘মেসির বিশ্বকাপ জিততে না পারা হবে ফুটবলের অবিচার। মেসির সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করাটা বোকামি। ’
দেখা যাক কাতার বিশ্বকাপ মেসির ভাগ্যে কী লিখে রেখেছে। ফুটবল দেবতা কি মেসির পাওনা শোধ করবেন, নাকি আরও অনেক বঞ্চিতের মতো তাকেও বিশ্বমঞ্চ থেকে ফিরতে হবে শূন্য হাতে! বুকে একটা বিশ্বকাপের আক্ষেপ নিয়েই ফুটবল বিশ্বকে বিদায় বলবেন ফুটবলের দুঃখী রাজপুত্র!
বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২২
এআর/এমএইচএম