বন (জার্মানি) থেকে: বন শহরে কেউ বেড়াতে এলে সাধারণত একটি গলি পথের সাধারণ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। যেখানে সব সময়ই ভিড় থাকে অজস্র আগন্তকের।
তিনি আর কেউ নন, বিশ্বখ্যাত সংগীতকার লুডভিগ ফান বেটোফেন। তার এই ছবিটিকেই লোকে চেনেন৷ পোস্টকার্ড, টিশার্ট এমনকি ছাতাতেও দেখা যায় তার এই অবয়ব৷ বহু সিনেমা নির্মিত হয়েছে বেটোফেনকে নিয়ে। লেখা হয়েছে অসংখ্য বই।
কোনো এক অজানার টানে বেটোফোন বনে টেনে আনেন লাখ লাখ পর্যটককে। এরা সবাই সঙ্গীত প্রেমী নন, তবে বেটোফেন প্রেমী। এরা মূর্তির সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন। মিউজিয়ামের দেয়ালে হাতড়ে বেড়ান বেটোফেনের স্পর্শ। আগ্রহ নিয়েই শুনতে থাকেন গাইডের বক্তৃতা। এ এক সত্যিকারের মায়ার জগত, যার পুরোটাই কেবল অনুভবের!
লুডভিগ ফান বেটোফেনের জন্ম ১৭৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর৷ যখন পশ্চিমা বিশ্বে সঙ্গীত কেবলই গীর্জা আর রাজবাড়ির বিষয় ছিল। সাধারণ মানুষের কাছে এর খুব একটা গুরুত্ব ছিল না৷ কিন্তু বেটোফেন পেরেছিলেন সংগীতকে সাধারণের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে৷ সৃষ্টি করেছিলেন সোনাটা, সিম্ফনি, বাজিয়েছেন পিয়ানো অর্কেস্ট্রা৷ সংগীতের এই নব্য প্রকাশ তৎকালীন ধ্রুপদী সংগীতের কেন্দ্র ভিয়েনা শহরের অনেকেই নাকি পছন্দও করেননি৷ তবে কেউ কেউ আবার উত্সাহিতও হয়েছেন৷
বেটোফেনই ছিলেন প্রথম সংগীতকার যিনি কারো নির্দেশে সংগীত রচনা করেননি৷ রাজার প্রভাব থেকে মুক্ত প্রথম স্বাধীন শিল্পী তিনি। হাইডেন বা মোত্সারটের মতো গির্জা এবং রাজাদের জন্য সংগীত রচনা করেননি বেটোফেন। নিজের আবেগ ও অনুভূতিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন সব সময়৷ তখনকার সময় অনেক সংগীত স্রষ্টার মতো বেটোফেনও তাৎক্ষনিকভাবে সংগীত রচনায় দক্ষ ছিলেন৷
তার শৈশব কেটেছে কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে৷ বাবা চেয়েছিলেন মোত্সারটের মতোই এক অবাক করা শিশু হবেন লুডভিগ৷ তাই তাকে শৈশবেই পিয়ানো বাজানো শেখা শুরু করতে হয়৷ জনসমক্ষে প্রথম পিয়ানো বাজান তিনি ৭ বছর বয়সে৷ ১৭ বছর বয়সে প্রিয় মাকে হারান লুডভিগ৷ মাদকসেবী বাবার সঙ্গে সম্পর্কটাও ছিল অনেকটাই শিথিল৷
বেটোফেন জীবনের অনেকটা সময়ই কাটিয়েছেন ভিয়েনায়৷ সেখানেই পেয়েছেন প্রভূত খ্যাতি ও সম্মান৷ সেই সাথে আর্থিক স্বাচ্ছলতাও ৷ সংগীতানুরাগী কিছু অভিজাত ব্যক্তির নজরে পড়ে বেটোফেনের বিশাল প্রতিভা৷ তারা তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসেন৷ ১৮১০ সালে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছান বেটোফেন৷ অন্যদিকে দীর্ঘ দিনের শ্রুতিজনিত সমস্যাটা এই সময়ে আরো বেড়ে যায় তার৷ ৯ বছর পরে একেবারেই বধির হয়ে পড়েন বেটোফেন৷ কিন্তু তবু সংগীত রচনা থেকে বিরত থাকেননি তিনি। ১৮২৪ সালে বিখ্যাত নবম সিম্ফনি শেষ করেন বেটোফেন।
কথিত আছে যে, বয়স ত্রিশ ছোঁয়ার আগেই তিনি ধীরে ধীরে তার শ্রবণশক্তি হারাতে থাকেন, কিন্তু এই ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মাঝেও তিনি বিশ্বকে বহুদিন ধরে অসাধারণ সব "মাস্টারপিস" উপহার দিয়ে যান। বেটোফেন ছিলেন প্রথম "ফ্রি-ল্যান্স" সুরকারদের একজন — তিনি ভাড়ায় কনসার্ট পরিচালনা করতেন, তার সুর প্রকাশকদের কাছে বিক্রি করতেন ও কিছু সহৃদয় ধনীর কাছ থেকে ভাতা পেতেন — গির্জা বা কোনো রাজকীয় সভায় স্থায়ী চাকরি করা তার স্বভাবে ছিল না। ১৮২৬ সালের মার্চ মাসে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন সংগীত জগতের কালজয়ী এই ব্যক্তিত্ব৷
বেটোফেন উৎসব
জার্মানির প্রাচীনতম সংগীত উৎসবের মধ্যে অন্যতম বন শহরের বেটোফেন সংগীত উৎসব৷ দেড়শ বছরেরও বেশি বয়স এই উৎসবের৷ অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আজ বড় একটি আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব হিসাবে খ্যাত বেটোফেন সংগীত উৎসব৷ প্রতি বছর আগস্টের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত চলে এই উৎসব৷
কালজয়ী সংগীত প্রতিভা লুডভিগ ফান বেটোফেন ছিলেন অসংখ্য ধ্রুপদী সংগীতস্রষ্টা ও সংগীতকারের দিক নির্দেশক৷ যারা তাকে অগাধ ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন, খ্যাতনামা পিয়ানোবাদক ফ্রানস লিসত্ও ছিলেন তাদের একজন৷ বেটোফেনের বিখ্যাত অনেক সিম্ফনির ওপর ভিত্তি করে পিয়ানোর জন্য সংগীতাংশ রচনা করেছেন তিনি৷ ১৮৩৯ সালে হঠাৎ একদিন তিনি জানতে পারেন, তার শ্রদ্ধাভাজন সংগীত স্রষ্টা বেটোফেনের জন্য জন্মস্থান বন শহর আর্থিক সংগতির অভাবে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারছে না৷ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ চিত্তে ত্বরিত গতিতে এই সমস্যার একটা সুরাহা খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি এবং উদ্যোগ নেন নিজেই অর্থ সংগ্রহ করার৷
১৮৪৫ সালের ১২ আগস্ট বন শহরেরই সুপরিচিত স্থান ম্যুনস্টারপ্লাত্সে এক মনোরম সংগীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হলো বেটোফেনের স্মৃতিস্তম্ভ৷ অনুষ্ঠানে ফ্রানস লিসত্ পরিচালিত অর্কেস্ট্রা মুগ্ধ করে শ্রোতাদের৷ সেই থেকে যাত্রা শুরু হলেও আজকের আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব উত্তরণের পথে দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয়েছে বেটোফেন উৎসবকে৷
স্মৃতিসৌধ উন্মোচনের পর নানা বাধা বিঘ্নের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে থাকে বেটোফেন সংগীত উৎসব৷ ১৯২০ এর দশকে বেশ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে উৎসবটি৷ কিন্তু এর পরপরই নগর কর্তৃপক্ষের উৎসাহে ভাটা পড়ে৷ বেটোফেন সংগীত উৎসবটিকে একেবারেই বাদ দেওয়ার চিন্তা করেন তারা৷ কিন্তু বন শহরের অধিবাসীরা তা মেনে নিতে পারেননি৷
নিজেদের উদ্যোগেই বেশ কয়েক বছর বেটোফেন উৎসবটি চালিয়ে যান তারা৷ এর ফলে নগর কর্তৃপক্ষেরও টনক নড়ে৷ উৎসবটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তারা৷ দায়িত্ব দেন একজন পরিচালকের হাতে৷
বেটোফেনের বাড়ি
যে বাড়িতে জন্মেছিলেন বেটোফেন, সেটাকেই তার ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী এবং তার সংগীত জীবনের নানা জিনিস সাজিয়ে একটি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে বেটোফেন হাউস৷ বনগাসে নামে সুপরিচিত একটি রাস্তার ধারে এই মিউজিয়ামটি শুধু দেশবিদেশের বেটোফেন অনুরাগীদেরই নয় সাধারণ মানুষেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷
প্রথম দৃষ্টিতে লুডভিগ ফান বেটোফেনের জন্মস্থান এই বাড়িটি অতি সাধারণ বলেই মনে হবে৷ কিন্তু দালানটির সামনে সবসময় মানুষের সমাগম দেখে বোঝা যায় যে এর একটি বিশেষত্ব আছে৷ জার্মানিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর যে কটি বাড়ি আজও টিকে আছে তারই অন্যতম এটি৷ বাড়ির সামনের দিকটি বারোক আঙ্গিকে পাথর দিয়ে তৈরি৷ বাড়ির সবচেয়ে ওপরের তলায় একটি ক্ষুদ্র কক্ষে ১৭৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন লুডভিগ ফান বেটোফেন।
মৃত্যুর আগে বেটোফেন সবশেষে যে পিয়ানোটি বাজিয়েছিলেন সেটি সংরক্ষিত আছে এখানে। ভিয়েনার কনরাড গ্রাফ নামে একজন পিয়ানো নির্মাতার কাছ থেকে মৃত্যুর দেড় বছর আগে পেয়েছিলেন তিনি এই পিয়ানো৷ ১৮৮৯ সাল থেকেই বেটোফেন হাউসে সযত্নে রক্ষিত আছে এই ঐতিহাসিক বাদ্যযন্ত্র।
এক সময় বন শহর বেটোফেনের স্মৃতিধন্য এই ভবন কেনার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি৷ তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই বাড়ি কিনে তার স্মৃতি রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়৷ ১৮৮৯ সালে গড়ে তোলা হয় বেটোফেন হাউস সংরক্ষণ সংস্থা ৷ প্রোথিত হয় আজকের বেটোফেন হাউস মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর৷ যা আজ সারা বিশ্বের মানুষকেই আকৃষ্ট করছে৷
বাংলাদেশ সময়: ১৮০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
আরএম/আইএ
** জলবায়ু পরিবর্তনের আভাস ইউরোপে
** শরণার্থী বিষয়ে কঠোর অবস্থানে জার্মানি
** এক পিলারেই তিন দেশের সীমানা
** ইউরোপে বাংলাদেশ বিমানের জন্য হাহাকার
** কূটনীতিতে মন নেই ব্রাসেলস দূতাবাসের
** ব্রাসেলসে প্যারিস হামলার প্রভাব
** বাংলাদেশি সব পণ্যই মেলে বেলজিয়ামে
** প্যারিসে বাংলাদেশ
** আমাদের কথা কেউ বলে না!
** ট্যাক্সি চালক থেকে মেয়র প্রার্থী
** হাঁটা পথে ইউরোপে
** প্যালেস ডি সালভাদর দালি
** প্যারিসে মলিন আবহে বড়দিন
** গির্জাভিত্তিক পর্যটন
** এনভার্সে জাকিরের দেখা
** বাস্তিল ঘিরে পর্যটন
** প্যারিসের গণতন্ত্র ময়দান
** বাতাক্লঁয়ে প্রতিদিনই আসছে মানুষ