ঢাকা: সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা কর্মঘণ্টার পর নিজস্ব হাসপাতালের চেম্বারেই ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখতে পারবেন। এই কার্যক্রমকে বলা হচ্ছে ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস।
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের কর্মস্থলে রাখা এবং রোগীদের স্বল্পমূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়ার উদ্দেশ্যে করা ‘ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
চিকিৎসকদের সরকারি হাসপাতালে চেম্বারে ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার সুবিধা এবং অসুবিধা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বাংলানিউজকে বলেন, নীতিগতভাবে এটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত। এতে সরকারি অবকাঠামোর যে সীমিত ব্যবহার, তার থেকে অনেক বেশি ব্যবহার করা যাবে। জনগণ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সুলভ মূল্যে একটা নৈতিক পরিবেশে সেবা পাবে, এটা একটা বড় সুবিধার বিষয় আছে। তবে এর সাথে আরও কিছু সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এবং পাইলটিংইয়ের মাধ্যমে যথাযথভাবে না করে এক সঙ্গে বাস্তবায়ন করাটা সম্ভব হবে কিনা, সেই বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
তিনি বলেন, যখন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা সেবা দেবেন, তখন সেখানে ডায়াগনস্টিক ফ্যাসিলিটিসহ অন্যান্য চিকিৎসা অবকাঠামো যদি না থাকে তাহলে রোগীর আবার পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বাইরে যেতে হলে অনৈতিকতার ঘাঁটি হয়ে যায় কিনা? আবার সেখানে যেহেতু ডুয়েল প্রাকটিস থাকবে, এমন না যে যারা ‘ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস’ করবে তাদের বাইরে প্রাকটিস বাদ দিয়ে সারাক্ষণ ইন্সটিটিউশনে থাকার বাধ্যকতা থাকবে, তেমনটাও না। হয়তো তারা রোটেশনাল ডিউটি করবে, যেমনটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। চিকিৎসকরা কিছুক্ষণ ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস করবে, আবার কিছুক্ষণ বাইরে প্রাকটিস করবে। সেক্ষেত্রে এটেন্ডেন্ট থেকে শুরু করে এসিস্ট্যান্টদের যে চেইন রয়েছে, তাদের মাধ্যমে রোগীদের ডায়ভার্ট করার জটিল প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় কিনা, যদি যথাযথ রেগুলেশন এবং নিয়ন্ত্রণ না থাকে। পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সুবিধা না থাকলে বাধ্য হয়ে রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা বাইরে থেকে করে আনতে হবে। তাই সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া বিষয়টা কতটুকু সফল হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যায়।
বিশিষ্ট এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী আরও জানান, ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট কিছুদিন আগে যে কষ্ট ব্রেক ডাউন ফলাফল প্রকাশ করলো, তাতে দেখা যায়, রোগীর খরচের ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধ এবং চিকিৎসা উপকরণে, বাকি শতাংশ খরচ হয় ডায়াগনস্টিকে। চিকিৎসকের ফিতে খুব বেশি খরচ হয় না। সব থেকে বেশি খরচ হয় ওষুধ, চিকিৎসা উপকরণ এবং ডায়াগনস্টিকে। সুতরাং যেখানে ব্যথা, সেখানেই ওষুধ দিতে হবে। অর্থাৎ সেটা কন্ট্রোল করার উপায়তো শুধুই ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস নয়।
রোগীর চিকিৎসা খরচ কমানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের এখনো বেশিরভাগ চিকিৎসা হচ্ছে ইনফরমাল সেক্টরের, অনেকে ফার্মেসি থেকেও সরাসরি ঔষধ ক্রয় করে খায়, কিছু চিকিৎসক অনৈতিকভাবে প্রেসক্রিপশন করছে, সার্টিফিকেটবিহীন চিকিৎসকও আছে, ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক প্রচার এবং প্রসার করছে, প্রাইভেট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণও নেই। এসব আইন আপডেট করা, সেই সঙ্গে যেসব স্থানে মানুষের পকেটের টাকা বেশি খরচ হয়, সেইখানে যদি আমরা সতর্ক না হই, তাহলে শুধু চিকিৎসকের ফি কমিয়ে (কমবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়) আগের মতোই সব কিছুই চলতে থাকবে আমার ধারণা। তার থেকে যদি চিকিৎসা, পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ওষুধপত্র সবকিছুই সরকারি হাসপাতালে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণেই হয়, তাহলে সেটা ভালো হতো।
ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস বিষয়ে তিনি বলেন, ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস প্রথমে পাইলটিং হওয়া উচিৎ যেখানে মেডিক্যাল শিক্ষা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যেন চিকিৎসা এবং মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দিতে পারেন। আমাদের সময় শিক্ষক সন্ধ্যাকালীন একটা রাউন্ড দিতেন। দিনে পাবলিক রিলেশন, পরীক্ষা, মিটিং নিয়ে ব্যস্ততা থাকলেও সন্ধ্যাকালীন রাউন্ডে আমরা বেশি শিখতে পারতাম। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত যদি ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস থাকে, তাহলে সেটা যদি এভাবে করা যায় যে, প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে পাইলট আকারে হবে, তারপর জেলা উপজেলা পর্যায়ে সামর্থ্য বৃদ্ধি করে বিস্তৃত করা হবে। আর ডুয়েল প্রাকটিস চালু রেখে, ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস কতটা সফল হবে, সেটাও সন্দিহান। যদি ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিস করতে হয়, তাহলে যথাযথ প্রণোদনা এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে যারা ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসে রাজি হবে, তাদের ফুল টাইম ইন্সটিটিউশনাল প্র্যাকটিসে রাখতে হবে। ডুয়েল প্রাকটিসে নৈতিকতার প্রশ্ন চলে আসে এবং সেটা নিয়ন্ত্রণ করাও খুব কঠিন হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩
আরকেআর