খুলনা: ‘আমি সুঁই দেখলে ভয় পাই। কিন্তু রক্ত দিতে গেলে একটা ভিন্ন অনুভূতি কাজ করে, মনে অন্য রকম একটা প্রশান্তি বিরাজ করে।
এই অনুভূতি মো. শামীম হোসেন নামের এক স্বেচ্ছাসেবক রক্তদাতার। তিনি এ পর্যন্ত ৩৫ বার রক্তদান করেছেন। শুধু শামীম নন, রক্ত দরকার শুনলে নিজে রক্ত দিতে অস্থির হয়ে যান অথবা যোগাড় করে দিতে হন্যে হয়ে পড়েন, এমন মহৎপ্রাণ তরুণ-তরুণীর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। খুলনায়ও আছেন এমন এক ঝাঁক রক্তযোদ্ধা।
শুক্রবার (১৪ জুন) বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। রক্তদানকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই দিনটি উদযাপন করে। দিবসটি উপলক্ষে মো. শামীমের পাশাপাশি খুলনার কয়েকজন রক্তযোদ্ধার অনুভূতি আর গল্প শুনেছে বাংলানিউজ।
সালাউদ্দিন সবুজ। খুলনা ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। ‘একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন’—এমন খবর পেলেই রোগীর ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে যান হাসপাতালে। রক্ত দিয়ে ফেরেন হাসিমুখে। সবুজের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রক্তদাতা সংগঠন ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে খুলনায় একদল তরুণের রক্তদান এখন রুটিন কাজ। স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা মানুষের পাশে থাকতে গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠন। রক্তদানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাত দিন তারা ছুটে বেড়ান মানুষের জীবন বাঁচাতে।
এ প্রসঙ্গে সালাউদ্দিন সবুজ বলেন, আমরা যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য, তারা হাজার হাজার টাকা দিয়ে হয়তোবা কাউকে সহযোগিতা করতে পারি না। কিন্তু প্রয়োজনের সময় এক ব্যাগ রক্তের দাম কোটি টাকার থেকেও বেশি। এই পর্যন্ত ৪০ ব্যাগ রক্ত দিয়েছি। আমি মনে করি এক ব্যাগ রক্ত মানে একটি নতুন জীবন, এই অনুভূতি অনন্য। যখন চিন্তা করি আমার রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে একজনের জীবন বেঁচে গেছে, তখন অজানা তৃপ্তি পাই। রক্ত দেওয়ার পর রোগীর স্বজনদের হাসিমুখই আমার পরম প্রাপ্তি।
বছরের পর বছর স্বেচ্ছায় মুমূর্ষু রোগীদের নিয়মিত রক্ত দান করে মানবতার সেবায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন খুলনা ব্লাড ব্যাংকের কোষাধ্যক্ষ আসাদ শেখ। কারও রক্তের প্রয়োজন পড়লে আসাদ তা সংগ্রহ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিকটাত্মীয়-স্বজন, বন্ধু এমনকি পরিচিতজনদের রক্তের গ্রুপ মোবাইল নম্বরসহ অসংখ্য ব্যক্তির নাম রয়েছে তার কাছে। কারও রক্ত লাগলে আসাদের সঙ্গে মোবাইলে অথবা সরাসরি যোগাযোগ করেন। তিনি তাৎক্ষণিক ওই ব্যক্তিকে নিজে রক্ত দেন অথবা রক্ত সংগ্রহ করে দেন।
এ প্রসঙ্গে আসাদ বলেন, রক্তের অভাবে দেশে প্রতিবছর অনেক রোগীর প্রাণ সংকটের মুখে পড়ে। এক ব্যাগ রক্ত দিতে বেশি সময়ে প্রয়োজন হয় না। আমি এ পর্যন্ত ৩৫ ব্যাগ রক্ত দিয়েছি। সবাই রক্তদানে এগিয়ে আসুন। মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচান।
নেগেটিভ রক্তের জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না বেশির ভাগ সময়। হাসপাতালে যখন রোগীতে ভর্তি করা হয়, তখন নেগেটিভ রক্তের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন রোগীর স্বজনরা। তখন বনতলা সুমা তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসে পাশে দাঁড়ান।
বনতলা সুমা বলেন, আমার রক্তের গ্রুপ বি-নেগেটিভ। এ পর্যন্ত ৫৮ বার রক্তদান করেছি। যখনই রক্তের রিকোয়েস্ট আসে, রক্তদানের সময় হলে কখনোই না করতে পারি না। আমার রক্তে বাঁচে যদি কোনো প্রাণ, তবে কেন নয় রক্তদান।
টকবগে তরুণ রক্তদাতা মেহেদী হাসান নিলয়। স্বেচ্ছায় মুমূর্ষু রোগীদের নিয়মিত রক্ত দান করে মানবতার সেবা করে চলছেন। নিলয় বলেন, রক্তদান আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। এ পর্যন্ত ৩৯ বার রক্ত দিয়েছি। এভাবে মানুষের পাশে থাকতে চাই আজীবন।
রক্তস্বল্পতা, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অগ্নিদগ্ধ রোগী, বড় অপারেশন, দুর্ঘটনা ইত্যাদি নানা কারণে রক্তের প্রয়োজন হয়। এমন সংকটময় মুহূর্তে খুলনা ব্লাড লাভার্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুরুজ কাণ্ডারি রূপে হাজির হন।
তিনি বলেন, রক্ত নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি। নিজে রক্ত দেই এবং প্রচুর রোগীকে রক্ত ম্যানেজ করে দেই। এই পর্যন্ত ২৩ বার রক্তদান করেছি।
মানবিক স্বেচ্ছাসেবী সুরভী লাইজু নামের অপর এক রক্তদাতা বলেন, আমি করোনাযোদ্ধা ছিলাম। রক্তদান একটি মহৎ এবং মানবিক কাজ। আমার রক্তের মাধ্যমে আরেকজন মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে, এর মতো মহৎ ও মানবিক কাজ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা নেই। যে কারণে এ পর্যন্ত ১০ বার রক্ত দিয়েছি। আজীবন এ ভালো কাজটি করে যেতে চাই।
ব্লাড ডোনার ফাউন্ডেশন খুলনার পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, ২০১৫ সালের রমজান মাসে ২৫ শে রমজান। আমি তখন সাতক্ষীরা পলিটেকনিকে লেখাপড়া করি। আমার তখন সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলে। তখনো রক্তদানের সঠিক অনুভূতি বুঝি না। আমি সকালে আমার ফোন অফ করে রেখে পরীক্ষা দিতে গেছি। পরীক্ষা শেষ করে বাসায় এসে দেখি আমার ফোনে ৩৪টা মিডস কল অ্যালার্ট। সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করি এবং একজন আমাকে জানান যে, ওনার স্ত্রীর প্রথম ডেলিভারি, ৩ থেকে ৪ ব্যাগ (এ পজেটিভ) রক্ত লাগবে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমার পকেটে ৪০ টাকা। আম্মাকে কল দিয়ে ১০০০ টাকা চাইলাম। আম্মার কাছে টাকা নেই, উনি ধার করে ৫০০ টাকা দিলেন। এবার যার কাছেই কল দেই সেই বলে রোজা, রোজা রেখে রক্ত দিতে পারবে না। বিকেল ৪টা পার হয়ে গেল, কোথাও রক্ত পেলাম না। এক পর্যায়ে চারজনকে নিয়ে খুলনা মেডিকেলে যাই। তিন ব্যাগ রক্ত লেগেছিল।
অনুভূতি জানিয়ে আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, ‘(অস্ত্রোপচারের পর) উনি এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলেন যে- উনি বাবা হয়েছেন। ওনার সন্তান ও স্ত্রী সুস্থ আছেন। ওনার জড়িয়ে ধরে কান্না করার সময় যে মনের প্রশান্তি পেয়েছি, এই প্রশান্তি-ই আমার জীবনের রক্তদানের সেরা অনুভূতি। সেদিন থেকেই নিয়ত করেছি, যতকাল বেঁচে থাকবো, ততকাল রক্তদান করে যাবো। এ পর্যন্ত ২৩ বার রক্ত দিয়েছি এবং ন্যূনতম টার্গেট ১০০ বার।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২৪
এমআরএম/এইচএ/