ঢাকা: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানো, চিকিৎসায় বাধা দেওয়া স্বৈরাচারের দোসর চিকিৎসকদের বিএমডিসি নিবন্ধন বাতিলসহ এক গুচ্ছ দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা।
বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শহীদ ডা. মিলন হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি এবং বিএসএমএমইউর অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার-১ মো. দেলোয়ার হোসেন টিটো। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রুহুল কুদ্দুস (বিপ্লব)।
সংবাদ সম্মেলনে বিএসএমএমইউর প্রক্টর ও ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা শেখ ফরহাদ, উপদেষ্টা অধ্যাপক মওদুদুল হক, উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. আতিয়ার রহমান, উপদেষ্টা এরফানুল হক সিদ্দিকী, উপদেষ্টা আতিয়ার রহমান, উপদেষ্টা শহিদুল ইসলাম, উপদেষ্টা মো. শাহিদুল হাসান বাবুল, সহ-সভাপতি এ কে আল মিরাজ, যুগ্ম-সম্পাদক এ কে এম কবির আহমেদ রিয়াজ, যুগ্ম-সম্পাদক ও অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার সাবিনা ইয়াসমিন, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ইয়াহিয়া খান, উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মশিউর রহমান কাজল, আকবর হোসাইন, দপ্তর সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ ঐক্য পরিষদ ও ড্যাব, বিএসএমএমইউ শাখার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বক্তারা বলেন, গত ১৬ বছরে স্বৈরাচারী শাসনামলে বিএসএমইউতে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে যে ধরনের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য হয়েছে, তা নজিরবিহীন। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পলায়নের পর বাংলাদেশ নতুন এক স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
তারা বলেন, ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকার এ দেশে একটি মাফিয়া শাসন কায়েম করেছিল। মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের প্রকৃত সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী।
সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শেখ ফরহাদ বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত প্রশাসনের আওয়ামী দোসররা আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, বাধা দেয়, পুলিশি হয়রানই করে।
তিনি বলেন, ৩ আগস্ট এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সি-ব্লকের সামনে চিকিৎসকের অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে দুজনকে রক্তাক্ত করা হয়। ৪ আগস্ট জ্বালাও-পোড়াও এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ নষ্ট করা হয়। এসব ঘটনায় বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শিগগিরই সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমরা প্রকাশ করব এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নেব।
তিনি আরও বলেন, গত ১৬ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। সুপার স্পেশালাইজড হাসাপতাল প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এবং বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা কনভেনশন সেন্টার নির্মাণে ভয়াবহ দুর্নীতি করা হয়েছে। ফলে আজ তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রক্টর শেখ ফরহাদ বলেন, ২০০৬ সালের আগে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের হয়রানি, চাকরিচ্যুতি, পদাবনতি ও উচ্চ শিক্ষা অর্জনে বাধা দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে আগের প্রশাসন। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, চিকিৎসা ও গবেষণাকে ধ্বংস করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা রয়েছে। সেই সভা থেকে আশা করছি ভালো কিছু সিদ্ধান্ত আসবে, যার মাধ্যমে একদিকে স্বৈরাচারের দোসরদের বিচারের মুখোমুখি করা প্রক্রিয়া শুরু হবে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আবারও শিক্ষা-চিকিৎসায় হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য এক গুচ্ছ দাবি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে-
আহত ছাত্র-জনতাকে যারা চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাধা দেন, তাদের তালিকা প্রণয়ন করে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা।
শান্তি সমাবেশে যোগ দেওয়া এবং ফ্যাসিবাদের দোসর সব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
গত ১৬ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সকল দুর্নীতি ও অনিয়মের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা এবং সব কেনাকাটা, টেন্ডার ও নির্মাণে অনিয়মের তদন্ত করে বিচার করা। ফ্যাসিবাদী সরকারের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীরা চাকরিচ্যুত, বরখাস্ত হয়েছেন তাদের স্ব-স্বপদে বহাল করা।
উচ্চ শিক্ষা অর্জনে যে বৈষম্যমূলক বাধা দেওয়া হয়েছে, তা দূর করা। বৈষম্যের শিকার সব শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারীদের অতি দ্রুত ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দিয়ে বৈষম্য দূর করা।
৪ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও ভস্মীভূত করার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণাসহ মামলা দায়ের করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।
সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত থেকে শুরু করে স্বৈরাচারের নিয়োগ করা সব ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরসহ অন্যদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের হিসাব দুদকের মাধ্যমে তদন্তের ব্যবস্থা করা।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা কনভেনশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে শিগগির মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অনতিবিলম্বে পরিবর্তন ও ৫ আগস্টের বিপ্লবের চেতনাবিরোধী সব ম্যুরাল ও মূর্তি সরিয়ে ফেলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ১৬ বছরে সংঘটিত সব অনিয়ম, দুর্নীতি ও বৈষম্য তদন্তে একটি শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিশন গঠন করা এবং ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসদের পদোন্নতি সংক্রান্ত ২০০৮ সালের প্রজ্ঞাপন ২০০৯ সালের ৩৩তম সিন্ডিকেট সভায় বাতিল করার সেই আদেশ অনতিবিলম্বে বাতিল করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেওয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২৪
আরকেআর/আরএইচ