হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস সংক্ষেপে এইচএমপিভি। চীনের উত্তর অঞ্চলে হঠাৎ করে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
চীনের সেন্ট্রার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশান বা সিডিসি'র ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এইচএমপিভি কোভিড-১৯ এর মতোই একটি আরএনএ ভাইরাস। অর্থাৎ এর জিনের গঠন একই। এই ভাইরাসও শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে। তবে এরা একই পরিবারের ভাইরাস নয়।
কোভিড-১৯ মহামারিতে সারাবিশ্বে ৭০ লাখ মানুষ মারা গেছেন। যে কারণে এইচএমপিভি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। রোববার (১২ জানুয়ারি) দেশে একজনের শরীরে এইচএমপিভি শনাক্ত হয়েছে। যার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরব এলাকায় বলে জানা গেছে।
যে কারণে বাংলাদেশেও ভাইরাসটি নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে।
এইচএমপিভি কি নতুন ভাইরাস, করোনার মতো মরণঘাতী?
ভাইরাসটি নতুন নয়; করোনার মতো মরণঘাতীও নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, ২০০১ সালে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়ত আরো অনেক যুগ আগে থেকেই এ ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে। সিডিসি জানিয়েছে, ভাইরাসটি অন্তত ৬০ বছর আগেই ছড়িয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এইচএমপিভিকে ‘শীতজনিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই ঘাবড়াবার কিছু নেই। কেননা চীনের সরকার বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও কেউই এখনও আনুষ্ঠানিক সতর্কতা জারি করেনি। এই ভাইরাস ভয়াবহ আকার ধারণ করবে কী-না সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরাও কোনো সতর্কবার্তা দেননি। তবে, রোগটি যাতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
তাছাড়া বাংলাদেশে ২০১৬ বা ২০১৭ সালের দিকে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল।
বাংলাদেশের ভাইরোলজিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি জানিয়েছে, এইচএমপিভি নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এর বড় কারণ হচ্ছে, এটি কোভিডের মতো নতুন কোনো ভাইরাস নয়। ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা ধাঁচের এই ভাইরাসে আগেও মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এর অর্থ হলো মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভাইরোলজিস্ট মাহবুবা জামিল বলেছেন, কোভিড ফুসফুসের যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করে, এইচএমপিভিতে ততটা ক্ষতি হয় না। শিশু, বয়স্ক, অন্তঃসত্ত্বা বা কঠিন কোনো রোগে আক্রান্তদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ তীব্র হতে পারে। কেননা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত দুর্বল থাকে।
করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এমন মানুষ বা করোনার টিকা নেওয়া ব্যক্তিও এইচএমপিভি-তে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে কোভিডের ইমিউনিটি রোগীকে এইচএমপিভি থেকে সুরক্ষা দেবে না।
রোগের উপসর্গ
এইচএমপিভি সংক্রমিত হলে সাধারণ জ্বর বা ফ্লুর মত উপসর্গ দেখা যায়। সঙ্গে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে। চামড়ায় র্যাশ বা দানা দানা দেখা দিতে পারে।
তবে, কারো কারো জন্য এসব উপসর্গ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বলছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে কোনো বয়েসী মানুষের ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মত অসুখ হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল তাদের মধ্যেই বেশি দেখা গেছে। আক্রান্ত হওয়ার পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে তিন থেকে ছয় দিন সময় লাগে।
কিন্তু আক্রান্ত হলে ঠিক কতদিন ভুগবেন একজন মানুষ তা নির্ভর করে সংক্রমণের তীব্রতা ও আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক সক্ষমতার ওপর
সংক্রমণ ঘটে যেভাবে
এইচএমপিভি সংক্রমিত হয় অনেকটা কোভিডের মতো।
সাধারণতঃ আক্রান্ত মানুষের হাঁচি বা কাঁশি থেকে ছড়ায়। এছাড়া স্পর্শ বা করমর্দনের মত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এইচএমপিভি ছড়াতে পারে।
সিডিসি বলছে, এইচএমপিভি রয়েছে এমন বস্তু বা স্থান স্পর্শ কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাঁশির ড্রপলেট লেগে থাকা স্থান যেমন দরজার হাতল, লিফটের বাটন, চায়ের কাপ ইত্যাদি স্পর্শ করার পর সে হাত চোখে, নাকে বা মুখে ছোঁয়ালে এইচএমপিভি ছড়াতে পারে।
এইচএমপিভির সংক্রমণ সাধারণত শীতের সময় বাড়ে, যখন মানুষ দীর্ঘ সময় ঘরের ভেতর সময় কাটায়।
ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী, তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মারা যাওয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এক শতাংশের মৃত্যুর জন্য দায়ী এইচএমপিভি।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতা বা ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগ আক্রান্তরা, সেইসাথে সিওপিডি, অ্যাজমা ও পালমোনারি ফাইব্রোসিসের মধ্যে শ্বাসযন্ত্রের রোগীদের মাঝে সংক্রমণের লক্ষণগুলো গুরুতর আকারে দেখা দিতে পারে। এমনকি তাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই জটিল রোগের আক্রান্তদের এমন লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা করা যাবে না।
শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হন
একজন মানুষ একাধিকবার এইচএমপিভি আক্রান্ত হতে পারেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্যে প্রথমবারের সংক্রমণের তীব্রতা বেশি থাকে। এরপর শরীরে এক ধরনের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, যার ফলে পরবর্তী সংক্রমণের তীব্রতা তত বেশি হয় না।
তবে এর ব্যতিক্রম হতে পারে যদি আক্রান্ত ব্যক্তির ক্যান্সার বা এইচআইভির মত দীর্ঘমেয়াদী অসুখ থাকে।
প্রতিরোধের ব্যবস্থা
এইচএমপিভি প্রতিরোধ এখনও সে ধরনের কোনো টিকা নেই। এই ভাইরাসের জন্য বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ নেই বা বিশেষ কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিও নেই ৷তাই সতর্ক থাকার ওপরেই জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনা মোকাবিলায় যেসব সতর্কতা নেয়া হয়েছিল, একই ধরনের পদক্ষেপে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন:
১. বাইরে গেলেই মাস্ক পরা।
২. ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান-পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া।
৩. হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা।
৪. আক্রান্তদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা। জন সমাগমস্থল এড়িয়ে চলা।
৫. হাঁচি কাশি দেয়ার সময় মুখ টিস্যু দিয়ে ঢেকে নেওয়া এবং ব্যবহৃত টিস্যুটি সাথে সাথে মুখবন্ধ করা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে হাত সাবান পানিতে ধুয়ে ফেলা।
৬. যদি টিস্যু না থাকে তাহলে কনুই ভাঁজ করে সেখানে মুখ গুঁজে হাঁচি দেওয়া।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি ও শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম করা।
৮. সর্দিকাশি, জ্বর হলেও অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
এসএএইচ