ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ২৯ রজব ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

রমেকের সেবায় নানা অবহেলা, নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট কজন

হারুন উর রশিদ সোহেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫
রমেকের সেবায় নানা অবহেলা, নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট কজন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

রংপুর: ৫ কেটি টাকা ব্যয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে স্থাপন করা হয়েছিল ডিজিটাল যন্ত্রপাতি। কিন্তু সেখানে কোনো কাজ হয় না।

বেকার পড়ে থাকা এসব যন্ত্রপাতিকে ধুলাবালি জমে। সরবরাহ নেই প্যাথলজি বিভাগের কোনো পণ্যের। এ অবস্থায় কঠিন সংকট দেখা দিয়েছে হাসপাতালটিতে। রোগীরাও পড়ছেন নানা বিড়ম্বনায়।

জানা গেছে, গত আড়াই বছর ধরে পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে ‘অ্যানালগ’ বা ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে রমেকে রোগ নির্ণয় করা হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকের তুলনায় সময় লাগে বেশি। রোগীদের পাশাপাশি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও সেবাদারকারী সংশ্লিষ্টরাও বিপাকে আছেন। যদিও হাসপাতালের পরিচালক আশা করছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান হবে। প্যাথলজি বিভাগের রিপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম কম্পিউটারাইজড করার উদ্যোগও নেওয়া হবে।

রোগীদের অভিযোগ ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক শ্রেণির চিকিৎসক, কর্মচারী ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠান বা প্যাথলোজিক্যিাল ক্লিনিক মালিকদের একটি চক্র হাসপাতালের অত্যাধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করার নেপথ্যের কারিগর। কারণ, আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে দিনে যে পরিমাণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যায়, সে অনুপাতে ‘অ্যানালগ’ বা ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতে দিনে সিকিভাগও করা সম্ভব নয়। ফলে রোগ নির্ণয়ের জট এড়াতে রোগীরা হাসপাতালের আধুনিক ডিজিটাল প্যাথলজিক্যাল সুবিধা না পেয়ে হাসপাতালের বাইরে বে-সরকারিভাবে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক বা প্যাথলোজিক্যিাল ক্লিনিকে রোগ নির্ণয় করাচ্ছেন।

এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কমিশন এজেন্ট হিসেবে হাসপাতালের ভেতরই কাজ করছেন চিকিৎসক, কর্মচারীসহ একটি দালাল চক্র। ফলে রমেকের ডিজিটাল ল্যাব ও প্যাথলজিক্যাল পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। একটি সূত্র বলছে, দালাল চক্রটি এমন কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে রেখেছে।

জানা গেছে, ডিজিটাল অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে রোগ নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘রি-এজেন্ট’ বা ‘বিকারক’ ব্যবহার করা হয়। ওই দালাল চক্রের কারণে এ উপাদান এখন আর হাসপাতালে সরবরাহ হয় না। এ উপাদান না থাকায় সেবা দানের মেশিনগুলোও অকেজো হয়ে আছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধি ও সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য ২০২২ সালের শেষের দিকে প্যাথলজি বিভাগে অত্যাধুনিক দুটি মেশিন স্থাপন করা হয়। এরমধ্যে একটি অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন। এর মাধ্যমে রক্তের গ্লুকোজ ও সিরাম ক্রিয়েটিনিন অর্থাৎ ডায়াবেটিস ও কিডনির রোগ নির্ণয় করা হয়। অপরটি অটোমেটিক সেল কাউন্টার মেশিন। এর মাধ্যমে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) করা হয় স্যাম্পল হিসেবে মেশিন দুটির সঙ্গে রি-এজেন্ট ব্যবহার করা হতো। কিন্তু একই বছরের নভেম্বরে সরবরাহ শেষ হয় বিকারকের।

এরপর থেকে রহস্যজনক কারণে হাসপাতালে রি-এজেন্ট বা রাসায়নিক দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হয়নি। অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার ও অটোমেটিক সেল কাউন্টার মেশিন দুটি চালাতে হাসপাতালের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় পুরনো যন্ত্রপাতির মাধ্যমেই সেবা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগে প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। অনেক সময় অ্যানালগ পদ্ধতিতে সঠিক রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে না। এছাড়া মূল্যবান যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুপাতে রোগ নির্ণয়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যে ব্যাপক রোগীর চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছেন প্যাথলজি বিভাগের সীমিত চিকিৎসক ও কনোলজিস্টরা।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন হাসপাতালে অন্তত ১ হাজার রোগী প্যাথলজি বিভাগে সেবা নিতে আসেন। এর মধ্যে মাত্র দেড় শতাধিক রোগীর রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। বাকি রোগীরা বে-সরকারিভাবে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠান বা প্যাথলোজিক্যিাল ক্লিনিকগুলো থেকে রোগ নির্ণয় করাতে বাধ্য হচ্ছেন। রমেক হাসপাতালের ডিজিটাল ল্যাব চালু থাকলে সেখানে দৈনিক অন্তত সাড়ে ৬০০ রোগীর রোগ নির্ণয় সম্ভব হতো। এতে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমে যেত। ভোগান্তির শিকার হতে হতো না।

হাসপাতালের ল্যাব টেকনোলজিস্ট মো. আলী আজম বলেন, রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় অত্যাধুনিক মেশিন বন্ধ রয়েছে। পুরনো মেশিন দিয়ে অ্যানালগ পদ্ধতিতে সব পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এতে সময় বেশি লাগছে। আবার অধিকাংশ বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রিপোর্টের কাগজ কম্পিউটারাইজড হয়ে গেছে। সেখানে রমেকের প্যাথলজি বিভাগের কার্যক্রম এখনো ল্যাবরেটরি ইনফরমেশন সিস্টেমের (এলআইএস) মধ্যে আনা হয়নি। প্রতিটি রিপোর্ট হাতে লিখতে হচ্ছে।

রমেক হাসপাতাল ও কয়েকটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, রমেকের প্যাথলজি বিভাগে সিবিসি পরীক্ষা করতে ফি নেওয়া হয় ১৫০ টাকা। সিরাম ক্রিয়েটিনিন ৫০ টাকা এবং ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষা ৬০ টাকা। বিপরীতে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিবিসি করতে নেওয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা, সিরাম ক্রিয়েটিনিনে ৪০০ এবং ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষায় নেওয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। এ কারণে রোগীদের স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার যে উদ্যোগ তা কাজে আসছে না।

হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শিহাব রেজওয়ানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেছেন, রি-এজেন্ট সরবরাহ না থাকায় অত্যাধুনিক অটোমেটিক সেল কাউন্টার ও অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন চালু করা যাচ্ছে না। অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার মেশিন ২০১৯ সাল থেকে বন্ধ। এটির চালুর কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। সিবিসির ক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপে পেরিফেরাল ব্লাড স্মেয়ার দেখে রোগ নির্ণয় করা হয়। বর্তমান আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের যুগে এ পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম। এছাড়া অন্যান্য পরীক্ষাও অ্যানালগ পদ্ধতিতে করতে হচ্ছে। এতে সময় অপচয় হচ্ছে। প্যাথলজি বিভাগে একদিনে যে পরিমাণ পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে অটো মেশিনগুলো চালু থাকলে তা ২-৩ ঘণ্টায় করা সম্ভব।

তিনি বলেন, মূল্যবান অত্যাধুনিক মেশিনগুলো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকলে এর মধ্যে থাকা মোটর, ভালভ, মুভিং অপশন, বিশেষ করে অপটিক্যাল মডিউল (ড্যাম বা ড্যামেজ) এবং অন্যান্য সূক্ষ্ম পার্টস নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি একাধিকবার হাসপাতালের পরিচালককে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমার নজরে এখনো কেউ আনেননি। তারপরও এখন সব কিছুই অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দ্রুত দরপত্র আহ্বান করব। আশা করি দুই-তিন মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে। প্যাথলজি বিভাগের রিপোর্ট সংক্রান্ত কার্যক্রম কম্পিউটারাইজড করার উদ্যোগও নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২৫
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।