হিমোফিলিয়া রোগের ভয়াবহতা বাড়লেও প্রতিরোধে সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এ রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় গাইডলাইন তৈরি করা, রোগী খুঁজে বের করে নিবন্ধনের আওতায় আনা, এই রোগের ওষুধ এসেনসিয়াল ড্রাগসের তালিকাভুক্ত করা ও তা সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ঢাকা ক্লাবে হেমাটোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় তারা এ তাগিদ দেন। বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রোগী, রোগীর অভিভাবক, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
হিমোফিলিয়া (Haemophilia) হচ্ছে এমন একটি বংশাণুক্রমিক জিনগত রোগ, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধতে সমস্যা হয়। তাই অল্প আঘাতে বা একবার রক্তনালী কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
গোলটেবিল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহ মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, হিমোফিলিয়া রোগ ভালো হয় না-এখন পর্যন্ত এমন কথা থাকলেও আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে জিন থেরাপি। নেপাল এটা করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আরও বেশি সক্ষমতা আছে, আমরাও পারবো। বাংলাদেশেও আমরা সেই পথে যাবো।
তিনি বলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ স্বপ্ন দেখা মা-বাবাদের সন্তানরা যখন হিমোফিলিয়া আক্রান্ত হন, তখন দুধে-ভাতে বাঁচার কথা ছেড়ে দিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকুক সেই স্বপ্ন দেখেন তারা। আমরা সেই ব্যবস্থা নিতে চাই-যার মাধ্যমে হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীও ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে।
এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির তাগিদ দেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাদের গণি চৌধুরী। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে হিমোফিলিয়া দিবস পালিত হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ। এটা জনসম্পৃক্ত অনুষ্ঠান হওয়ার দরকার ছিল। তাহলে এ রোগের প্রতিকারে ব্যাপক মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানো যেতো।
হিমোফিলিয়া রোগের প্রতিরোধে তিনি সরকারি সব হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। কাদের গণি চৌধুরী বলেন, হিমোফিলিয়া রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ায় এটাকে ‘রাজকীয়’ রোগ বলে অভিহিত করা হয়। টাকার অভাবে গরিব মানুষ চিকিৎসা করতে পারে না, এমন যেন না হয়।
তিনি বলেন, ভারতে শিশুদের আশঙ্কাজনকভাবে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। প্রতিবেশী দেশটিতে প্রতি ৫০০ জনের মধ্যে একটি শিশু এ রোগে আক্রান্ত। ভারত থেকে বাংলাদেশ দূরে নয়। এজন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনতাই পারে এই রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, দেশে সরকারি হিসাবে হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর যে সংখ্যা বলা হয়, বাস্তবে তা আরও বেশি। হেমাটোলজি সোসাইটির প্রদত্ত সংখ্যাও সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সঠিক চিত্র নেই মানেই মানুষ চিকিৎসা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত।
হেমাটোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব ডা. মো. আদনান হাসান মাসুদ অনুষ্ঠানে বলেন, হিমোফিলিয়া চিকিৎসার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না থাকা। বাজারেও ওষুধ পাওয়া কঠিন। আবার দামও বেশি। এজন্য শনাক্ত হওয়ার পর অনেকে হাসপাতালমুখি হতে চান না।
তিনি সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যের দোকান প্রতিষ্ঠা এবং আমদানিতে শুল্ক ও শুল্কবর্হিভূত প্রতিবন্ধকতা দূর করার তাগিদ দেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আকতার হোসেন, অধ্যাপক ডা. সালেহ উদ্দিন, অধ্যাপক ডা. আব্দুল আজিজ, ডা. কামরুল ইসলাম, ডা. মোর্শেদ জামান, ডা. হুমাইরা নাজনীন ও ডা. গুলজার হোসেন।
বক্তারা বলেন, হিমোফিলিয়া আক্রান্ত হওয়া মানে পুরোপুরি সুস্থ জীবন থেকে ছুটি নেওয়া। ডাক্তার মা-ও যখন আক্রান্ত শিশুর জন্য কাঁদেন, তখন বোঝা যায় এই রোগ নিয়ে আমরা কোথায় আছি, আক্রান্ত সাধারণ মানুষ কী অবস্থায় বেঁচে থাকে!
তারা বলেন, হিমোফিলিয়া রোগীরা অত্যধিক গরিব। তাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে আসার মতও খরচ থাকে না। সরকারের পক্ষ থেকে ক্যানসার রোগীর মতো হিমোফিলিয়া রোগীকেও ৫০ হাজার করে টাকা দেওয়া হোক, যাতে এসব রোগীকে সেবা দেওয়া যায়।
বক্তাদের ভাষ্যে, সার্জারির জন্য অতিরিক্ত খরচ হওয়ার কারণে প্রয়োজন মতো চিকিৎসা দেওয়া যায় না। এমনও আছে কেউ কেউ, চিকিৎসা নেওয়ার জন্য এসেছে, কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে হিমোফিলিয়া রোগী নাজমুল আলম বলেন, আপনাদের সমস্যাগুলো সরকার শুনলেও পরে তারা তা ভুলে যায়। সরকারকে এগিয়ে আসত হবে। হিমোফিলিয়া রোগ ৭০ শতাংশ বংশগত। বাকি ৩০ শতাংশ হঠাৎ চলে আসে। কার কখন চলে আসে বলা যাবে না, এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
শিশু হিমোফিলিয়া রোগীর মা ডা. আফরোজা বলেন, সময় মত ওষুধ সরবারহ পাওয়া যায় না। আর না পাওয়া গেলে শিশু ঝুঁকিতে পড়ে। আমি চিকিৎসক হিসাবে কোনোদিন বিদেশে স্থায়ী হওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু দেশে হিমোফিলিয়া রোগের ভালো চিকিৎসা না থাকা এবং এ রোগীর বিষয়ে সামাজিক ভীতির কারণে ছেলেকে নিয়ে বিদেশের চলে যাওয়ার কথা ভাবছি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে এ রোগের ভালো চিকিৎসা করা গেলে ভালো হয়ে ওঠে। আবার সামাজিকভাবেও তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয় না।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২৫
জেডএ/এইচএ/