ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

“আর যক্ষ্মায় মৃত্যু নয়”

মোঃ আবু জাফর সাদেক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫২ ঘণ্টা, মে ২, ২০১৪
“আর যক্ষ্মায় মৃত্যু নয়”

”যক্ষ্মা মানে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি” এমন কথা আগে বহুল প্রচারিত হলেও ধীরে ধীরে তা কমতে শুরু করেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে যক্ষ্মা মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসলেও এর ভয়াবহতা উল্লেখ করার মতো।



পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী তাদের শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু বহন করে এবং তা বছরে শতকরা ১ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালে বিশ্বে ৮৮ লক্ষ লোক নতুন করে যক্ষ্মা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে যার মধ্যে মারা গেছেন প্রায় ১৫ লক্ষ। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এদের মধ্যে প্রায় ৭০,০০০ জন মৃত্যুবরণ করেন। তথ্য বিবেচনায় বাংলাদেশ যক্ষ্মা ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির তালিকায় ৬ষ্ঠ অবস্থানে। চলুন দেখি যক্ষ্মা কি ধরণের রোগ।

যক্ষ্মা হলো ব্যাকটেরিয়া (মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস) গঠিত সংক্রমন যা প্রধানত বাতাস বা অন্যকিছুর সংস্পর্শে একজনের কাছ থেকে অন্যজনের কাছে ছড়িয়ে যেতে পারে। সংখ্যা বিবেচনায় যক্ষ্মার প্রধান শিকার হলো ফুসফুস এর বাইরেও কিডনি, মূত্রনালী, হাঁড়, জিহ্বার নিম্নাংশ, মস্তিস্ক, অন্ত্র, চোয়াল, কানের লতি, উরু, কুনুই, কব্জি, বুক প্রভৃতি অংশও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারে।

যক্ষ্মার জীবাণু প্রবেশ করা মাত্রই শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী পদ্ধতি সক্রিয় হয়ে তা বধ করার চেষ্টা করে। এই পর্যায়ে যক্ষ্মা জীবাণু সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত না হলে তা সক্রিয় বা সুপ্ত অবস্থায় শরীরে অবস্থান করে। সক্রিয় অবস্থা দ্রুত লক্ষণ প্রকাশ করলেও সুপ্তাবস্থা শরীরে রোগ প্রতিরোধকারী পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগ বিবেচনা করে সক্রিয় উঠতে পারে, যে কারণে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তির যক্ষ্মা হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী। প্রতি দশ জন সুপ্ত যক্ষ্মা জীবাণুধারীর কমপক্ষে ১ জন সক্রিয় যক্ষ্মায় পরিবর্তিত হয়, যেক্ষেত্রে মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ।

লক্ষণ :
ব্যক্তি ও সংক্রমণভেদে যক্ষ্মার লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যক্ষ্মা আক্রান্তের তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ নাও হতে পারে। তবে অতি সাধারণ লক্ষণ গুলো: দীর্ঘস্থায়ী/রক্তযুক্ত কাশি, ক্ষুধামান্দ্য, বদহজম, জ্বর না সাড়া, অবসাদগ্রস্ততা, ওজন কমে যাওয়া, রাতে বেশী ঘামা, বুক ব্যথা, শরীর ঠান্ডা অনুভূত হওয়া প্রভৃতি।

রোগ নির্ণয় :
বায়োপসি, ব্রোঙ্কোসকপি, বুকের সিটিস্ক্যান, এক্সরে, কফ পরীক্ষা, থোরাসেন্টেসিস, টিউবারকুলিন স্কিন টেস্ট প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে। ত্বক পরীক্ষা সব সময়ে সঠিক ফল নাও দিতে পারে তাই সর্বদা ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

সম্ভাব্য ঝুঁকি সমূহ :
কোনো কোনো ক্ষেত্রে যক্ষ্মা আক্রান্ত ফুসফুস তার স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা হারাতে পারে। যক্ষ্মার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ সমূহের প্রতিক্রিয়ায় যকৃতের ক্ষতি সাধিত হতে পারে। এর বাইরে দৃষ্টি শক্তি লোপ, শরীরে দানা/চাকা হওয়া,  মূত্রের রং পরিবর্তন প্রভৃতি হতে পারে।

প্রতিরোধের উপায় :
যক্ষ্মা প্রতিরোধযোগ্য, এমনকি কেউ যদি সর্বোচ্চ ঝুঁকিতেও থাকে। যক্ষ্মা ছড়িয়ে পড়লে অতিদ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন কারণ তা রোগীর পাশাপাশি তাঁর আশে পাশের অন্যজনের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। অনেক দেশে যক্ষ্মা প্রতিরোধে বিসিজি টিকা দেওয়া হয় যদিও এর কার্যকারীতা বেশ সীমিত।

ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল :

যক্ষ্মার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো আফ্রিকা যার মধ্যে নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর পরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যার মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া অন্যতম। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার অন্য স্থানগুলো হলো রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ আমেরিকা প্রভৃতি।

কারা ঝুঁকিপূর্ণ :
এইডস/এইচআইভি, ডায়বেটিকস, ক্যান্সার, কিডনির সমস্যা, কেমোথেরাপিগ্রহণ, আথ্রাইটিস, অপুষ্টি প্রভৃতি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নিয়ামক। আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারী, চিকিৎসা সেবা দানকারী, যক্ষ্মা রোগীর কাছের স্বজনসহ অনেকেই এই রোগের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

ব্যবস্থাপনা :
পূর্ণ মেয়াদে সঠিক চিকিৎসায় যক্ষ্মা থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। যক্ষ্মা চিকিৎসায় জীবানু রোধে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। যক্ষ্মা রোগের কার্য্যকর ও সঠিক চিকিৎসা একটু কঠিন কারণ এর দায়ী জীবাণুর গঠন ও প্রকৃতি অস্বাভাবিক যা এন্টিবায়োটিক প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করতে সক্ষম। যক্ষ্মা চিকিৎসায় বেশ দীর্ঘ সময় ধরে ওষুধ খেতে হয়। সুপ্ত যক্ষ্মা একক এন্টিবায়োটিকে ভালো হয়ে গেলেও সক্রিয় যক্ষ্মা সারাতে একাধিক ওষুধ সেবন করতে হয়। অন্য আর যে সব ওষুধ যক্ষ্মা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় সেগুলো হলো পাইরাজিনামাইড, ইথামবিউটল, এমিকাসিন, মক্সিফ্লক্সাসিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, প্রোথিওনামাইড প্রভৃতি । এই রোগে ঔষধ সেবনের ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে দৃশ্যমান উন্নতি বোঝা সম্ভব। ১ মাস চিকিৎসা পর এক্সরে পরীক্ষা দ্বারা রোগ থেকে কি পরিমাণ উন্নতি হলো তা অনুমান করা যায়। এখানে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমটি হলো যক্ষ্মার ওষুধ অবশ্যই পূর্ণ মেয়াদে খেতে হবে তাতে লক্ষণ থাকুক আর নাই থাকুক আর দ্বিতীয়টি হলো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।

কোথায় যক্ষ্মার চিকিৎসা পাওয়া যায়: যক্ষ্মা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন দাতা/উন্নয়ন সংস্থা অত্যন্ত প্রসংশনীয় ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রায় সব সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে যক্ষ্মার চিকিৎসা পরামর্শ ও ওষুধ দেওয়া হয়। কিছু বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার নির্দিষ্ট কেন্দ্রে অত্যন্ত স্বল্প বা বিনামূল্যে যক্ষ্মার চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেক চিকিৎসক তাদের নিজস্ব চেম্বারে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

মোঃ আবু জাফর সাদেক
ফার্মাসিস্ট ও সিনিয়র ডেপুটিম্যানেজার
রেনাটা লিমিটেড, ঢাকা, বাংলাদেশ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।