নীলফামারী থেকে: সময়মতো ওষুধ সেবন ও নিয়মিত ব্যায়াম করলে ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের বিকলাঙ্গতা দূর করা সম্ভব বলে মনে করেন দেশের একমাত্র ফাইলেরিয়া বিশেজ্ঞ ডাক্তার এফএএম তৈয়ব হোসেন।
নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ধলাগাছ এলাকায় অবস্থিত বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) তিনি।
বাংলানিউজকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ডা. তৈয়ব হোসেন বলেন, ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত রোগী সঠিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করলে ৯০ শতাংশ সুস্থ হয়ে উঠবেন। কোনো রোগীই বিকলাঙ্গ হয়ে থাকবেন না।
আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ফাইলেরিয়া নিয়ে দ্রুত না ভাবলে সারা দেশই ঝুঁকির মুখে পড়বে। তবে এখন পর্যন্ত ফাইলেরিয়া আক্রান্ত এলাকাগুলোর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, দিনাজপুরের খানসামা, রানীরবন্দর, পার্বতীপুর, কুড়িগ্রামের চিলমারী এবং উলিপুর। এসব এলাকা নিয়ে বেশ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় থাকতে হচ্ছে।
এছাড়া উত্তরবঙ্গে ফাইলেরিয়ার জোন হিসেবে ধরা হয়েছে নীলফামারী জেলাকে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে নীলফামারীর জলঢাকা ও রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। সব মিলিয়ে সারাদেশে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত। পর্যায়ক্রমে এদের বেশির ভাগই বিকলাঙ্গ হয়ে পড়বে।
তিনি জানান, ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশে ফাইলেরিয়া রোগ দেখা দেয়। চার ধরনের স্ত্রী মশা ফাইলেরিয়ার পরজীবী জীবাণু বহন করে থাকে। তবে বাংলাদেশে বেশি মাত্রায় এ পরজীবী বহন করে থাকে কিউলেঙ প্রজাতির স্ত্রী মশা। মানুষের ঘর-বাড়িতে এ ধরনের মশার বাস বেশি। তবে ঘরের আশপাশে নোংরা জলাশয় ও নালা-নর্দমায় এ মশা ডিম পাড়ে এবং প্রজনন ঘটায়। এ মশায় আক্রান্ত মানুষের দেহের লসিকা গ্রন্থিতে থাকা কৃমি থেকে জন্ম নেয় ফাইলেরিয়ার পরজীবী।
এ ক্ষুদ্র পরজীবী জীবাণু মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়। ফাইলেরিয়া জীবাণু রোগীর লসিকানালিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ণবয়স্ক হয় এবং লসিকানালিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। কালক্রমে লসিকা গ্রন্থি ফুলে ও বন্ধ হয়ে লসিকা প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটায়।
ধীরে ধীরে রোগীর হাত-পা, অণ্ডকোষ, যৌনাঙ্গ ফুলে উঠে। এক পর্যায়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হতে থাকে। ফলে রোগীর স্বাভাবিক জীবন যাপনের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
ডা. তৈয়ব হোসেন জানান, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সর্বস্তরে জোরদার না থাকায় এই রোগের বিস্তার ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়ছে। তবে সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এর আওতায় বছরে একবার একজনকে বিনা মূল্যে অ্যালবেনডাজল ও ডাই-ইথাইল কার্বামাজিন ওষুধ (ডিইসি) খাওয়ানো হয়। বয়সভেদে ওষুধগুলো নিয়ম অনুযায়ী সেবন করানো হবে।
বাংলানিউজকে তিনি আরও বলেন, ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত বিকলাঙ্গ রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিলে রোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে চিকিৎসা নিতে পারবে। একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারবে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি বাড়িতে সম্ভব। বিধায় চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে আসার প্রয়োজন নেই। এতে তারা সুস্থ জীবন যাপন করবে। এজন্য সবাইকে সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ আবশ্যক। তাছাড়া চিকিৎসা, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে যা যা করা প্রয়োজন
করণীয়-১ : সাবান ও পানি দিয়ে আক্রান্ত অঙ্গ দিনে দুইবার ধুতে হবে। এতে করে রোগী অনেকটা স্বাভাবিকভাবে হাঁটচলা করতে পারবে। ফোলা অঙ্গটির ফোলা আর বাড়বে না এবং ব্যথা অনুভব করবে না। পরিষ্কার নরম কাপড়ের টুকরা দিয়ে প্রতিটি ভাঁজ, আঙ্গুলের ফাঁক ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। এ কাজ রোগী নিজে করতে না পারলে তাকে পরিবারের কেউ সাহায্য করতে পারেন। রোগীকে এ কাজে সহযোগিতা করলে সুস্থ ব্যক্তির ফাইলেরিয়া আক্রান্ত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই।
করণীয়-২ : সাবান পানি দিয়ে ধোওয়ার পর আক্রান্ত অঙ্গ, আঙ্গুলের ফাঁক এবং প্রতিটি ভাঁজ পরিষ্কার নরম কাপড় দিয়ে হালকাভাবে চেপে চেপে শুকাতে হবে। এ কাজ করতে গিয়ে যেন কোনোভাবেই ত্বকে ক্ষতের সৃষ্টি না হয়। যদি আঙ্গুলের ফাঁকে বা ত্বকে ক্ষত থাকে তবে চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ছত্রাক/জীবানুনাশক মলম লাগাতে হবে।
করণীয়-৩ : কাজের সময়, বিশ্রামের সময় এবং ঘুমানোর সময় যতটা সম্ভব আক্রান্ত পা আরামদায়কভাবে শরীরের চেয়ে কিছুটা উঁচুতে উপরে তুলে রাখতে হবে। এতে পা ফোলা আর বাড়বে না।
করণীয়-৪ : দিনে রাতে নিয়মিত অন্তত কয়েকবার আক্রান্ত অঙ্গের হালকা ব্যায়াম করতে হবে। এতে আক্রান্ত পায়ের সঞ্চালনের উন্নতি হবে এবং চলাচল সহজ হবে।
করণীয়-৫ : আক্রান্ত পা পরিষ্কার রাখতে হবে। যতটুকু সম্ভব খোলা স্যান্ডেল ব্যবহার করতে হবে, যাতে করে পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে আঘাত না লাগে।
এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা আরও যা যা করবেন।
• ঠাণ্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখতে হবে যতক্ষণ ব্যথা না কমে।
• বেশি করে পানি পান করতে হবে।
• বিশ্রাম নিতে হবে।
• চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শক্রমে জ্বরনাশক/ জীবানুনাশক ওষুধ সেবন করতে হবে।
• জীবানুনাশক ক্রিম আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে।
তাৎক্ষণিক আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে
• ব্যায়াম করা যাবে না।
• আক্রান্ত স্থানের ত্বকের উপর কোনো প্রকার গরম পানি বা গরম স্যাঁক দেয়া যাবে না।
• লতা-পাতা, ছাই ইত্যাদি আক্রান্ত স্থানে লাগানো যাবে না।
• আক্রান্ত অঙ্গে কোনো প্রকার টাইট ব্যান্ডেজ দেয়া যাবে না।
• আক্রান্ত অঙ্গ কেটে কোনো প্রকার পানি বা রক্ত বের করা যাবে না।
• আক্রান্ত অঙ্গের ত্বকের কোনো ফোসকা গলানো যাবে না।
ডা. তৈয়ব হোসেন বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে দেশকে খুব তাড়াতাড়ি ফাইলেরিয়া মুক্ত করা সম্ভব।
ফাইলেরিয়া রোগের প্রতি সরকারকে গুরত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, প্রচার প্রচারণাসহ সব বিষয়ে সরকার সহযোগিতা করলে ফাইলেরিয়া নির্মুল করা সম্ভব।
** ফাইলেরিয়ায় বিকলাঙ্গ হতে বসেছেন উত্তরের মানুষ
বাংলাদেশ সময় : ১০৩৭ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৪