ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বেহাল দশায় স্বাস্থ্যসেবা

চিকিৎসক-কর্মচারী ও যন্ত্রপাতি সংকটে বরিশাল সদর হাসপাতাল

মুশফিক সৌরভ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪
চিকিৎসক-কর্মচারী ও যন্ত্রপাতি সংকটে বরিশাল সদর হাসপাতাল ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরিশাল: চিকিৎসক, কর্মচারী ও যন্ত্রপাতির সংকট নিয়েই রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে বরিশাল জেনারেল (সদর) হাসপাতাল।

পাশাপাশি জায়গা সংকট ও বয়সের ভাড়ে ভারাক্রান্ত ভবনের বেহাল দশায় পুরো চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমই চলছে হুমকির মুখে।



১০০ শয্যার এই হাসপাতালটির বহিঃবিভাগে প্রতিদিন গড়ে তিনশ’ ও আন্তঃবিভাগে গড়ে প্রতিদিন একশ’র বেশি রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে।

তবে চিকিৎসক, কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে হাসপাতালটি তার পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

এ বিষয়ে রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করে বলেন, জ্বর ও দুর্বলতার কারণে ৩ বছরের শিশু সুবর্ণাকে নিয়ে নগরীর ভাটিখানা এলাকার বাসিন্দা পারভীন বেগম জানান, সকালে বহিঃবিভাগে এসেছি বাচ্চাকে ডাক্তার দেখাবো বলে। রোগীদের ভিড় ও মাত্র ১জন চিকিৎসক থাকায় ২ ঘণ্টা পর বেলা ১২টায় ডাক্তারের কাছে যেতে পেরেছি।

সেই সঙ্গে প্রচণ্ড গরমে নিজেকেই অসুস্থ বলে মনে করছেন বলে জানান তিনি।

এখানে প্যাথলজি বিভাগের কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা ও মেনুয়াল এক্সরে ছাড়া উন্নত চিকিৎসায় সহায়ক কোনো যন্ত্রপাতিই নেই।

হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল, প্যাথলজিস্ট পোস্টগুলোতে মাত্র ১ জন করে কর্মী থাকায় কেউ যদি ছুটিতে থাকেন সেদিন সেই বিভাগের পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ থাকে।

এছাড়াও হাসপাতালের একমাত্র আলট্রাসাউন্ড মেশিনটিও দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে আছে। ইসিজির জন্য একটি মেশিন থাকলেও তা পরিচালনার জন্য নেই কোনো টেকনোলজিস্ট। ডিজিটাল এক্সরে করার কোনো ব্যবস্থা তো নেই-ই বরং ম্যানুয়াল বা সনাতন পদ্ধতির যে তিনটি এক্সরে মেশিন আছে তারও আবার দু’টিই নষ্ট। আর সচল মেশিনটি ভবনের ছাদ দিয়ে পানি পড়ার কারণে বৃষ্টিতে বন্ধ রাখা হয়। ফলে রোগীদের পড়তে হয় সীমাহীন দুর্ভোগে।

অর্থোপেডিক বিভাগে চিকিৎসা নিতে বরিশাল নগরীর পলাশপুরের বাসিন্দা অনিক (১৫) জানান, তার ডান পায়ে ব্যাথার কারণে হাঁটতে পারছেন না। সকাল ৯টায় হাসপাতালে এসে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে দেখাতে পারলেও ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনের অভাবে তিনি সদর রোডের অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যান। তবে সড়কে যানজট থাকায় যাওয়া আসার পধে তাকে প্রায় দেড়ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়।

এদিকে ডেন্টাল বিভাগে জনবল থাকলেও সেখানে নেই কোনো ডেন্টাল ইউনিট। এমনকী চেয়ারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নেই সেখানে।

নামে জেনারেল হাসপাতাল হলেও এখানে নেই সামান্য অপারেশনের সরঞ্জামও। আধুনিক সরঞ্জাম তো দূরের কথা একটি মাত্র ওটি টেবিল তাও ভাঙা। আর ওটি টেবিলের ওপর থাকা লাইটেরও একই অবস্থা। ফলে চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে অস্ত্রপচারের কাজ।

পাশাপাশি বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থা জেনারেটর না থাকায় ও হাসপাতালের একমাত্র পানি বয়েল করার মেশিনটি প্রায়ই বিকল হওয়ায় অস্ত্রপচার ও এর সরঞ্জাম বিশুদ্ধ করণের কাজ ব্যহত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে সংক্রমণ রোগের ঝুঁকি।

যান্ত্রিক এসব ত্রুটির কথা স্বীকার করে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, যন্ত্রপাতি চেয়েও না পাওয়ায় অনেক কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো রোগীকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নয়তো বাহির থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে এনে ব্যবস্থাপত্র দিতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকরা।

পুটয়াখালির বাউফলের বাসিন্দা ও বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে গত বৃহষ্পতিবার বিকেলে ভর্তি হওয়া চিকিৎসাধীন আব্দুল হালিম খান (৫৪) জানান, তিনি নানাবিধ শারীরিক সমস্যার কারণে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তির পর চিকিৎসক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই হাসপাতালে করতে পারেননি তিনি। সব পরীক্ষাই হাসপাতালের সামনের পদ্মা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করতে হয়েছে। অথচ এটা সরকারি হাসপাতাল।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন, ডায়েরিয়া, চর্ম ও যৌন, চক্ষু ডেন্টাল, শিশু বিভাগসহ ১০টি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। তবে এর মধ্যে নাক-কান-গলা বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় এ বিভাগের সেবাটিই বন্ধ রয়েছে। একই সাথে ডেন্টাল বিভাগের যন্ত্রপাতি না ধাকায় রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেওয়া ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না বলে জানান ভারপ্রাপ্ত ওই মেডিকেল অফিসার।

চিকিৎসকদের মঞ্জুরিকৃত ৩২টি পদের বিপরীতে শূন্যপদ রয়েছে ১৩টি।

হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্র জানায়, গাইনি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ১টি, মেডিসিন বিভাগে সিনিয়র কনসালটেন্ট ১টি, আবাসিক মেডিকেল অফিসারের একটি মাত্র পদও দীর্ঘদিন যাবৎ শূন্য রয়েছে। তবে ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. দেলোয়ার হোসেন।

এছাড়াও ইএমও ৪টি পদের ১টি, আইএমও ২টি পদের মধ্যে ২টিই, মেডিসিনের সহকারী রেজিস্ট্রার ২টি পদের মধ্যে ২টি, সার্জারির সহকারী রেজিস্ট্রার ২টি পদের মধ্যে ২টিসহ মোট ১৩টি পদ শূন্য থাকায় মোট ১৯ জন চিকিৎসক এ হাসপাতালে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

এদিকে চিকিৎসক এর পাশাপাশি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।

প্রশাসনিক বিভাগ জানায়, এ হাসপাতালে একজন মাত্র ওয়ার্ড মাস্টার দায়িত্ব পালন করছেন। অ্যাম্বুলেন্স চালক আছেন দু’জন। স্ট্রেচার বেয়ারার দু’টি পদের মধ্যে দুটিই শূণ্য। বাবুর্চির ৬টি পদ থাকলেও আছে ২জন। এমএলএসএস এর পদ ২০টি। কিন্তু এ পদে কর্মরত আছেন ৭জন। ঝাড়–দারের ১২ পদের মধ্যে আছে ৪জন। আর সরদারের পদতো একেবারেই খালি।

তবে সেবিকাদের কোনো সংকট নেই জানিয়ে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট, কর্মচারীসহ সব শূন্যপদ পূরণের জন্য বার বার লিখিত দেওয়া হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। তবে অজানা কারণে সে পদগুলো আজো পূরণ হয়নি। আর জনবল সংকটের হাসপাতালে কর্মরত কেউ কোনো কারণে ছুটিতে গেলে এ অঞ্চলের রোগীদের পড়তে হয় বিপাকে। হাসপাতালটি নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোড সংলগ্ন হওয়ায় এখানে রোগীর চাপও বেশি বলে দাবি করেন এই চিকিৎসক।

হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে ১০০ শয্যার অনুকূলে সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন ও ডায়েরিয়া রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে এখানে মূলত ডায়েরিয়া ও গাইনি রোগীর প্রধান্য বেশি দেওয়া হয়। এ হাসপাতালে ১২ বছরের উর্ধ্বে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। বেডের তুলনায় রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায় প্রায়ই হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় রেখেই রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।

১৯১২ সালের ১৩ জুলাই চালু হওয়া বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল পুরাতন দুটি ভবনের ছাদের পলেস্তারা প্রতিনিয়ত খসে খসে পড়ছে। বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হচ্ছে এক্স-রে যন্ত্রসহ মূলবান যন্ত্রপাতি। একমাত্র ঔষধাগার ও স্টোরের দেওয়াল চুঁয়ে পানি আসছে ভিতরে।

পাশাপাশি হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলার ফ্লোরে বৃষ্টির সময় স্যাঁতস্যাতে থাকায় সেখানে মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের বাড়তি রোগী রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

সংস্কারের তাগিদ দেওয়া হলেও দীর্ঘদিন সংস্কার হচ্ছে না। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের দাবি, বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অংশ। এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগের। অন্যদিকে গণপূর্ত বিভাগের দাবি, ২৫০ শয্যার নিচের হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, প্রশাসনিক ভবন, ইমারজেন্সি ভবন, ডায়রিয়া বিভাগ এবং অপারেশন থিয়েটারের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে আহত হচ্ছে চিকিৎসক এবং রোগী।

আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের অধিকাংশ ভবনের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। গণপূর্ত বিভাগে একাধিকবার সংস্কারের জন্য আবেদন করা হলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। সর্বশেষ মে মাসে বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।

গণপূর্ত বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন বলেন, বরিশাল জেনারেল হাসপাতালটি মূলত স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের অধীনে। তাই গণপূর্ত বিভাগ সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারছে না। ২৫০ শয্যার নিচের হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের।

বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ ও জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. মু. কামরুল হাসান সেলিম বলেন, নানা সমস্যার কথা আবাসিক মেডিকেল অফিসার জানিয়েছেন। মূলত এর সংস্কারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের। তাদের সাথে এটি সংস্কারের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে অতিদ্রুত কাজ শুরু হবে। আর চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতি সংকটেও পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।