ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ ও বদলিতে কোথায় কত ঘুষ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪
স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ ও বদলিতে কোথায় কত ঘুষ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: স্বাস্থ্যখাতে নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতির প্রতিটি ধাপেই অনিয়ম দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
 
প্রতিবেদনে বলা হয় অ্যাড হক চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়োগে দলীয় তদবিরের পাশাপাশি নিয়ম-বহির্ভূত অর্থের লেনদেন হয়।


 
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাড হক চিকিৎসক নিয়োগে ৩ থেকে ৫ লাখ এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
 
এছাড়া বদলির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ঢাকা এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলায় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা, চিকিৎসকদের উপজেলা এবং সদর থেকে ঢাকায় বদলি ১ থেকে ২ লাখ, দুর্গম এলাকা থেকে সদরে, এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় এবং উপজেলা থেকে সদরে বদলি ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বদলি ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ, সুবিধাজনক স্থানে দীর্ঘদিন অবস্থানের জন্য আড়াইলাখ টাকা এছাড়া ডিপিসির মাধ্যমে পদোন্নতির জন্য ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
 
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক পরিচালিত ‘স্বাস্থ্য খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
 
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালী হোটেল অবকাশে এ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক রফিক হাসান এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম. আকরাম। প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আক্তার।
 
টিআইবি জানায়, এসব অনিয়ম ও লেনদেনে দলীয় নেতা, কর্মচারী ইউনিয়ন নেতা, অফিস প্রধান সহকারী, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একাংশের যোগসাজোশ রয়েছে। এছাড়া, চিকিৎসকদের সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনভিত্তিক অলিখিত চুক্তির মত অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এ কমিশনের হার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ এবং দালালদের ক্ষেত্রে কমিশন ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
 
গবেষণা প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে বিদ্যমান একাধিক সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে এখাতের উন্নয়নে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়।
 
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের চিকিৎসা সেবাদানকারী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের জনবল ব্যবস্থাপনা, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা, সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রম এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের তদারকি ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
 
খসড়া প্রতিবেদনটি গত ২৮ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মাঝে উপস্থাপন করে তাদের মূল্যবান মতামত প্রতিবেদনে সন্নিবেশন করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানায় টিআইবি।
 
গবেষণা প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে যেমন, দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক সেবা পৌঁছে দেওয়া, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ওষুধ শিল্পকে একটি রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত করা, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি প্রচলনে ব্যাপক প্রচারণা, সেবা বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস, সকল সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে লালসবুজের বিশেষ মোড়কে ওষুধ সরবরাহ, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি, জাতীয় চক্ষুসেবা কার্যক্রমের আওতায় সাত লাখের অধিক রোগীকে বিনামূল্যে অপারেশন এবং লেন্স সরবরাহ, সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ, এসএমএস এর মাধ্যমে অভিযোগ-পরামর্শ প্রেরণ ইত্যাদি।
 
প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট জনবলের ২০শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে।
 
অন্যদিকে বিদ্যমান জনবলের অনুপাত বিশ্ব মানদণ্ড অনুপাতে খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী চিকিৎসক ও জনসংখ্যা অনুপাত ১:৬০০ হলেও বাংলাদেশে এ অনুপাত ১:৩২৯৭, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে ডাক্তার ও নার্সের স্বীকৃত অনুপাত ১০:৩, বাংলাদেশে এ অনুপাত ১:০.৪।
 
৬৪টি জেলার মধ্যে ২৬টি জেলায় ডেপুটি সিভিল সার্জন পদ তৈরী করা হলেও ছয়টি জেলায় উক্ত পদে পদায়ন নেই। হাসপাতালের সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া, হাসপাতালে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা প্রভাব, হাসপাতাল অভ্যন্তরে দালারের মাধ্যমে হয়রানির শিকার ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে।
 
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসনীয় ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে সুশাসন নিশ্চিত করে কার্যকরভাবে দুর্নীতি ও বহুমুখী অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এ খাতে অর্জন ও অগ্রগতি আরো অনেক ভাল হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
 
তিনি বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্জিত অগ্রগতির স্থায়ীত্ব ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতের মত মৌলিক অধিকার খাতে আর্থিক বরাদ্দ বিব্রতকরভাবে নিম্নমানের, যার প্রভাবে স্বাস্থ্য অবকাঠামো, জনবল ও গুণগত চিকিৎসা সেবায় প্রত্যাশিত মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। আর্থিক বরাদ্দ উদ্বেগজনকভাবে নিম্নমুখী এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সঠিকভাবে জাতীয় প্রাধান্য নির্ধারণ অপরিহার্য।
 
গবেষণার ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণে টিআইবি’র পক্ষ থেকে ১৭ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করা হয়।
 
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, বিভিন্ন শূন্য পদ পূরণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, জনবল নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দূর করা, পদোন্নতিতে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে যোগ্যতার বিভিন্ন সূচকে স্কোরিং ব্যবস্থা চালু করা, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সংসদ সদস্যদের সক্রিয় উদ্যোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর করা, রোগীর তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি হাসপাতালে তথ্য ও অনুসন্ধান ডেস্ক কার্যক্রম চালু করা, চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার ক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, বিএমডিসি’র ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত চিকিৎসকদের ডিগ্রি বা যোগ্যতাসহ তালিকা প্রকাশ এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা, ক্রয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া চালু করা এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণে তদারকি কার্যক্রম ব্যবস্থা জোরদার করা।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৪

** ৩,২৯৭ জনের জন্য একজন ডাক্তার!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।