পঞ্চগড়: পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল। সীমান্তঘেঁষা এ অঞ্চলের সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসার নাম।
প্রতিষ্ঠার দুই দশক পর হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করে আধুনিক হাসপাতালে পরিণত করা হলেও তাতে চিকিৎসাসেবায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কলেবর বৃদ্ধির পরও প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও উল্টো দক্ষ জনবল ও অব্যবস্থাপনাগত সমস্যার কারণে ধুঁকে ধুঁকে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল সংকটে জর্জরিত এ সদর হাসপাতালে সুচিকিৎসা পাওয়া তাই দুরুহ হয়ে উঠেছে। ফলে জেলার দূর-দূরান্ত থেকে আসা দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা ও সেবা দিতে পারছে না এ হাসপাতাল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ষাটের দশকে তৎকালীন পঞ্চগড় মহুকুমায় ক্ষুদ্র পরিসরে পঞ্চগড় স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে এ হাসপাতালের ভিত গড়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালে পঞ্চগড় জেলা ঘোষণার পর ৫০ শয্যায় উন্নীত করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে পঞ্চগড় সদর হাসপাতাল নামকরণ করা হয়।
এর ২১ বছর পর গত ২০০৫ সালে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়ে পরিণত হয় আধুনিক সদর হাসপাতালে। এরপর থেকেই দেখা দেয় চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় জনবল সংকট। যা আজও ঘোঁচেনি।
চিকিৎসক সংকটের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ছোট জেলা শহর হওয়ায় পঞ্চগড়ে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ কম। ফলে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে উত্তীর্ণ চিকিৎসকরা এখানে পদায়ন হওয়ার পর বেশিদিন থাকতে চান না।
হাসপাতালের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, পঞ্চগড় হাসপাতালে পদায়নকে চিকিৎসকরা বিভাগীয় শান্তিমূলক বদলি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাই বাধ্য হয়ে অনেক চিকিৎসক এখানে যোগদান করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে তদবির করে অন্যত্র চলে যান।
জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত এই হাসপাতালে প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় ৩/৪শ রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। আর আন্তঃবিভাগে ভর্তি থাকেন প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ জন। ১০০ শয্যা হওয়ায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন রোগীকে প্রায় সবসময়ই মেঝেতে অবস্থান নিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়।
এদিকে, জনবলের পাশাপাশি এখানে ওষুধের অপ্রতুলতা রয়েছে। ফলে চিকিৎসক ও নার্স সংকটের সঙ্গে ওষুধের স্বল্পতা রোগীদের নিত্য ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ হাসপাতালে।
১০০ শয্যার এই আধুনিক সদর হাসপাতালে ৩৬ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও এর বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৮ জন। দ্বিতীয় শ্রেণির নার্স পদে ৪০টি জনের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৩৬ জন।
তবে কর্মরত নার্সদের মধ্যে কয়েকজন ডেপুটেশনে থাকায় সবসময়ই নার্স স্বল্পতা রয়েই গেছে। ফলে নার্সিং ট্রেনিং ইনিস্টিটিউটের ১১০ জন শিক্ষানবিশ নার্সকে দিয়ে চালানো হচ্ছে আপাত সেবা কার্যক্রম।
তবে ভয়াবহ সংকট রয়েছে তৃতীয় শ্রেণি ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষেত্রে। এই দুই পদে ৫৮ জনের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ২৭ জন। ৩১টি পদ শূন্য রয়েছে। ফলে হাসপাতালের দৈনন্দিন কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
হাসপাতালটিকে বর্তমানে সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ১ জন, জুনিয়নর কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া) ১ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজিস্ট) ১ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি) ১ জন, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ১ জন ও মেডিকেল অফিসার ২ জনসহ মোট ৭ জন কর্মরত আছেন। তবে জরুরি বিভাগের জন্য জরুরি মেডিকেল অফিসারের অনুমোদিত ৩টি পদই রয়েছে খালি।
এছাড়া সিনিয়র কনসালটেন্ট ৭টি পদের মধ্যে ৬টি, জুনিয়র কনসালটেন্ট ১০টি পদের মধ্যে ৭টি পদই খালি রয়েছে। নেই কোনো প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট ও ডেন্টাল সার্জন। এছাড়া সহকারী সার্জনের ৭টি অনুমোদিত পদের মধ্যে সবগুলোই খালি রয়েছে।
এদিকে, পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নেই কোনো গাইনি কনসালটেন্ট। ফলে প্রতিনিয়ত প্রসূতি রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৫ জন গর্ভবতী মাকে সিজার করানো হয় এখানে। গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডা. খ. ম. আরিফুর রহমান নামের এক মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলছে সিজারিয়ান অপারেশন।
অন্যদিকে, হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে এক্সরেসহ সব ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও জনবল সংকটের কারণে তাও কাজে আসছে না। মাত্র একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব.) দিয়ে চালানো হচ্ছে প্যাথলোজি ও ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম।
জনবল ঘাতটি পূরণে আপাতভাবে গত ৩ আগস্ট সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত মেডিকেল অফিসারদের বর্তমানে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
তবে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৩তম বিসিএস উত্তীর্ণ চিকিৎসকদের নতুন নিয়োগ দেওয়া হলেও পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে নতুনদের কাউকে এখন পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায় এসব তথ্য।
রোববার ভোরে পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়া পঞ্চগড় শহরের ডোকরোপাড়া হুমায়ুন কবির (৪৫) বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালে কিছু ওষুধ পেলেও বাইরে থেকে ২টি ইনজেকশন কিনতে হয়েছে তাকে।
হাসপাতালে নার্সদের সেবা নিয়ে অভিযোগ করে তিনি জানান, রোগীর তুলনায় নার্স কম হওয়ায় অনেক সময় তাদের ডেকেও পাওয়া যায় না।
অপরদিকে, রোগী ও সেবা নিতে আনা সাধারণ মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি ভোগান্তিতে রয়েছেন খোদ হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
২০০৫ সালে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে চিকিৎসকসহ হাসপাতালের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বসার ও থাকার জায়গার তীব্র সংকট রয়েছে হাসপাতালে।
এসব সমস্যা সমাধানে সদ্য বিদায়ী সিভিল সার্জন ডা. মোজাম্মেল হক হাসপাতালে নতুন করে জেনারেটর স্থাপন, হেলপ ডেক্স, রোগীদের হেলথ এডুকেশনের জন্য টেলিভিশন স্থাপন, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল রাখতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী ওবায়দুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে যে ৭ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন তারা সবাই হাসপাতাল কম্পাউন্ডে বসবাস করছেন। তবে সম্প্রতি যে ৬ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এরমধ্যে এই হাসপাতালে নতুন করে কেউ আসলে তাদের আবাসন ও দাপ্তরিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে নিশ্চিত সংকট দেখা দেবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পঞ্চগড়ের সির্ভিল সার্জন ডা. মো. আহাদ আলী বাংলানিউজকে জানান, তিনি চলতি মাসের ৪ তারিখে এ জেলায় এসেছেন।
আধুনিক সদর হাসপাতালের জনবল সংকট ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে সিভিল সার্জন বলেন, ১০০ শয্যার আধুনিক সদর হাসপাতালে জনবল সংকটে চিকিৎসাসেবা প্রদান অত্যন্ত দুরুহ। জনবল চেয়ে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৪