সুনামগঞ্জ: জনগণ সেবা ও সেবা প্রদানের বিষয়গুলোর সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত নয়। তাদের কাছে সেবা গ্রহণের সঠিক তথ্য পৌঁছেনি।
ফলে সরকারি-বেসরকারি অনেক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানে না বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)পরিচালিত এক গবেষণা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং একই উপজেলার দু’টি কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়।
জরিপ শেষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শতকরা ৭০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী সেবায় সরকারি ভর্তুকির কথা জানেন না। শতকরা ৯৫ ভাগ চিকিৎসা সেবা গ্রহীতা জানান ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী খুব কম ওষুধই তারা সেবাকেন্দ্র থেকে পান।
জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩৫ ভাগ রোগী স্বাস্থ্যসেবায় কেন্দ্রর সেবা সম্পর্কে জানেন। শতকরা ২৫ ভাগ রোগী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করান। তবে হাসপাতালের কল্যাণ তহবিল সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ রোগীদের মাত্র অর্ধেকের মতো রোগী ওয়ার্ডে সিট পেয়েছেন। তবে তারা নার্স ও চিকিৎসকদের সেবার মান নিয়ে সন্তুষ্ট।
এ গবেষণা জরিপের জন্য উপজেলার চারজন (চিকিৎসক ব্যতীত) সেবা প্রদানকারীরর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এদের মধ্যে একজন স্টোরকিপার, একজন নার্স, একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান ও একজন ফার্মাসিস্ট।
তাদের সবার মন্তব্য সেবাকেন্দ্রগুলোতে টেলিমেডিসিনের ব্যবস্থা না থাকলেও রোগীরা অন্যান্য সুবিধাদি পান। এছাড়া কেন্দ্রগুলোতে মা ও শিশুসেবার মান পর্যাপ্ত।
তবে বেশিরভাগ উত্তরদাতা বলেছেন, সেবা গ্রহণকারীর অনুপাতে প্রয়োজনীয় কর্মী ও সেবা উপকরণ নেই। সব কেন্দ্রেই অ্যাম্বুলেন্স ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। আছে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা ও বিনামুল্যে ওষুধের তালিকা।
তবে অর্ধেকের বেশি উত্তরদাতা জানিয়েছেন, হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্রগুলোতে যে ওষুধ পাওয়া যায় তা পর্যাপ্ত নয়।
জরিপে জেলার চারজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। তারা জানান, উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকলেও প্রযোজনীয় ওষুধ ও কর্মচারী সঙ্কট রয়েছে।
তারা জানান, মা ও শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সেবা অপ্রতুল এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কোনো তালিকা নেই। প্রয়োজনীয় বাজেটের জন্য তারা সঠিকভাবে সেবা দিতে পারেন না। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো। তবে তাদের কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সচল অ্যাম্বুলেন্স ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রায় অর্ধেক কেন্দ্রে জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে। এসব কেন্দ্রে প্রযোজনীয় ওষুধ ও যন্ত্রপাতি আরো অধিক পরিমাণে প্রয়োজন বলে তারা জানান।
ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবা গ্রহণকারী এক পুরুষ ও এক নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তারা বলেন, সেবা প্রদানকারীরা তাদের সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র দেন। কিন্তু তারা বিনামূল্যে ওষুধ পান না।
তারা জানান, এসব কেন্দ্রে প্রসূতি সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা চালু আছে। টয়লেট ও পরিবেশ পরিষ্কার- পরিছন্ন হলেও নেই বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। সেবার মান বাড়াতে ইউনিয়ন পর্যায়ের কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো উচিত বলে তারা মনে করেন।
এদিকে, গবেষণা জরিপে উঠে আসা তথ্যের আলোকে সুপ্র তাদের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়েন কিছু সুপারিশ করে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবার জন্য সুপারিশসমূহ হলো, কমিউনিটি ক্লিনিক ম্যানেজমেন্ট কমিটির মিটিং নিয়মিত ও কার্যকর করা, সেবা গ্রহীতাদের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পর্কে আস্থা তৈরিতে সেবার মান অধিক বহুমুখী করা এবং সেবার অবকাঠামো উন্নয়নে জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রের জন্য সুপ্রর সুপারিশ হলো, সেবা গ্রহীতাদের আস্থা তৈরিতে কেন্দ্রে সেবার মান আরো বহুমুখী করা, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও বিশেষজ্ঞ সেবা প্রদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা।
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য সুপারিশ হলো, প্রতিটি পর্যায়েই সেবার মান বৃদ্ধিতে উপরিকাঠামোর দুর্বলতার দূর করা, জনগণকে সেবা ও সেবা প্রদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত করে তোলা, সেবা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান, জনবল সংকট দূর করা, পর্যাপ্ত বাজেট ও বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং সেবার ক্ষেত্রে মনিটরিং ব্যবস্থা কার্যকর করা।
সুপ্রর এ গবেষণা জরিপ ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জেলার স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানা যায়, জেলায় মোট ২৫৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রস্তাবিত রয়েছে। এর মধ্যে ২১৪টি ক্লিনিক চালু হয়েছে। নিমার্ণাধীন রয়েছে ২১টি কমিউনিটি ক্লিনিক। মোট ২২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, যার মধ্যে ১৬টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র।
এছাড়া জেলার ১১ উপজেলার মধ্যে ১০টিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। নবগঠিত দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ হয়নি। জেলায় মোট ৩টি ২০ শয্যাবিশিষ্ট উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে কৈতক কেন্দ্রটি চালু। অন্য দু’টি মধ্যে দিরাই উপজেলার জগদলে নবনির্মিত আর মধ্যনগরে নির্মাণাধীন রয়েছে।
সুপ্রর গবেষণা জরিপ ও জেলার স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল হেমিক বাংলানিউজকে বলেন, জেলার ২১৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ২২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে ২০ ভাগ ক্লিনিকে বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে।
বিদ্যুৎ লাইন অথবা বিদ্যুতের খুঁটির ৩শ’ ফুটের মধ্যে রয়েছে এমন কেন্দ্রে চলতি বছরের মধ্যেই বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৫