বগুড়া: কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কি ধরনের সেবা পাওয়া যায়, তা যেমন জানেন না আগত সেবাগ্রহীতারা। তেমনি এসব বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ কোনো ধারণা দিতেও পারছে না স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো।
যদিও উচ্চ পর্যায়ে বা নীতি-নির্ধারণী মহল থেকে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই বলেই দাবি করা হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) পরিচালিত বগুড়া জেলার স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হচ্ছে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবার ওপর নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতের জন্য সুপ্র দেশের ১২টি জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। তারই অংশ হিসেবে বগুড়া জেলার বেশ কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করে সুপ্র।
পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্র জানায়, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সীমাবদ্ধতা দূর, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, জনমত তৈরি এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য নিরীক্ষা কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হয়েছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক
সুপ্রর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জেলার অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে জ্বর, ঠাণ্ডা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায়। নবজাতক ও শিশুদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সেবাগ্রহণকারীদের মতামত, অভিযোগ ও উপদেশ গ্রহণের রেজিস্ট্রার রয়েছে। যা পরিচালনা কমিটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে। তবে এখানে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা কোনো টয়লেট নেই। একটি মাত্র টয়লেট সবাইকে ব্যবহার করতে হয়।
কিমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা রোগীরা জানান, সকাল ১০টার পর ক্লিনিকগুলো খোলা হয়। আবার দুপুর ১টার মধ্যে কার্যক্রম বন্ধ করে চলে যান ক্লিনিকের কর্মীরা। সচরাচর সরকারি ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা এখানে আসেন না।
তবে প্রসূতি নারীদের জরুরি অবস্থায় বিনা ভাড়ায় অ্যাম্বুলেন্স পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানান তারা।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র
জেলার গাবতলী উপজেলার রামেশ্বরপুরসহ কয়েকটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন দ্বিতল। এসব কেন্দ্রে শিশু ও প্রসূতির সেবা গ্রহণের সুযোগও রয়েছে। ভবনে আবাসিক সুবিধা থাকলেও কর্মচারীদের থাকতে দেখা যায় না। অধিকাংশ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা উপকরণ ও কর্মচারী নেই।
বিশুদ্ধ খাবার পানি ও টয়লেট সুবিধা থাকলেও সরকারি সময়সূচি মেনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি খোলা রাখা হয় না বলে অভিযোগ রোগীদের।
রোগীর নাম রেজিস্ট্রার খাতায় লেখা হলেও সীলমোহরযুক্ত কাগজে ওষুধ সরবরাহ না করে সাদা কাগজে ওষুধের নাম ও পরিমাণ লেখা হয়। যেখানে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর স্বাক্ষর থাকে না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
প্রতিবেদনে বলা হয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের ব্যবহার মোটামুটি ভালো হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও সেবাদানকর্মী না থাকায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সেখানে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো, কর্মচারী ও ওষুধের সংকট রয়েছে। মা ও শিশু সেবা পর্যাপ্ত থাকলেও টেলিমেডিসিনের কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয় না।
এখানকার অ্যাম্বুলেন্স, এক্স-রে মেশিন ও অপারেশন থিয়েটার সব সময় কার্যকর থাকে না। হাসপাতালের কোয়ার্টারে চিকিৎসকরা থাকেন না। তবে কিছু লোক বিনা পয়সায় সেখানে বাসবাস করে আসছেন।
হাসপাতাল এলাকায় বিশুদ্ধ পানিসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। স্ট্যান্ডিং কমিটি থাকলেও এর কার্যকারিতা নেই।
দায়িত্বরত চিকিৎসক, মেডিকেল সহকারীদের সেবায় রোগীরা মোটামুটি সন্তুষ্ট থাকলেও চিকিৎসকরা কর্মস্থলে আসতে প্রায় প্রতিদিনই দেরি করেন বলে অভিযোগ করেছেন রোগীরা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনোযোগ দিয়ে শোনা হয় না রোগীদের কথা। সরকারি ওষুধ বাইরে বিক্রি করারও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।
ওই প্রতিবেদনে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানানো হয়, উপজেলা, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, টেকনিশিয়ান ও ওষুধের কোনো তালিকা দৃশ্যমান স্থানে রাখা হয়নি। সেবাকেন্দ্রগুলোতে প্রতিবন্ধীদের সেবা প্রাপ্তির ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। নেই কোনো তথ্য সেবাকেন্দ্রও।
জেলার সিভিল সার্জন অফিসেও প্রতিবন্ধীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
সুপ্র’র বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক কে জি এম ফারুক বাংলানিউজকে জানান, এই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সেবাগ্রহণকারী ও সেবাদানকারীর সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারি সেবার পর্যাপ্ততা, মান, দুর্বলতা ও সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
তিনি জানান, সমস্যা উত্তরণে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে স্থানীয়ভাবে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ও স্থানীয় সরকারের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
কে জি এম ফারুক আরো বলেন, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ মোতাবেক সিটিজেন চার্টার প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। সিটিজেন চার্টারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের টেলিফোন বা মোবাইল ফোন নম্বর অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। যাতে তাৎক্ষণিকভাবে জনসাধারণ তাদের অভাব-অভিযোগ জানাতে পারেন।
তিনি জানান, উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলোতে তথ্যকেন্দ্র স্থাপনসহ সমাজসেবা তহবিল চালু করারও সুপারিশ করা হয়েছে। সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষণ ও পরিদর্শন কার্যক্রম নিয়মিত জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থার পাশাপাশি অতিরিক্ত সিভিল সার্জনের পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ বাস্তবায়িত হলেই মিলবে প্রয়োজনীয় সেবা। তাই জরুরি ভিত্তিতে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সিটিজেন চার্টার টাঙানো দরকার বলেও উল্লেখ করেন ফারুক।
বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. আফজাল হোসেন তরফদার বাংলানিউজকে জানান, সবকিছু মিলিয়ে সেবাকেন্দ্রগুলোতে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। যা শিগগিরিই দূর করা সম্ভব হবে। ২০১৩ সালে বগুড়া জেলায় প্রায় ৩৮ লাখ ও ২০১৪ সালে প্রায় ৫২ লাখ মানুষকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে।
মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ ওষুধ বরাদ্দ থাকায় সামান্য ওষুধ ঘাটতি রয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
কয়েকদিন আগেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান হবে বলেও জানান সার্জন ডা. আফজাল হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৫