বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ১৫৬.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১৭৪ জন লোকের বাস। তাদেরকে সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম ও মেধাবী জাতি হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব।
গর্ভবতী হলে প্রয়োজন হাসপাতালে গিয়ে কমপক্ষে ৪ বার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, প্রসবকালীন সময় মাকে হাসপাতালে নিয়ে প্রসব করানো, প্রসবের পরপর নবজাতকের যত্ন নেওয়া এবং জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে নবজাতককে বুকের শাল দুধ দেওয়া। এছাড়া পুনরায় গর্ভধারণ করতে চাইলে কমপক্ষে ২ বছরের বিরতি দেওয়া এবং সেজন্য সন্তান জন্মের ৪২ দিন পর থেকে সেই দম্পতিকে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করা, টিকা কেন্দ্রে নিয়ে শিশুকে নিয়মিত টিকা দেওয়াও প্রয়োজন।
গবেষণায় দেখা গেছে, শুধুমাত্র এ কয়েকটি কাজ করতে পারলে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমে আসে। এজন্য কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই স্থাপনা কিংবা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরও। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমাতে প্রয়োজন শুধুমাত্র আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী ও সেবাদান কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে উল্লেখিত নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে কাজে লাগানো।
আর এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।
১৯৯৪ সালে কায়রোতে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ফর পপুলেশন ডেভেলপমেন্ট (আইসিপিডি) বা কায়রো সম্মেলনে ১৮০টি দেশের সমন্বয়ে প্রজনন স্বাস্থ্য উন্নয়ন সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ আইসিপিডিতে স্বাক্ষরকারী অন্যতম একটি দেশ। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালে ১৮৯টি দেশের সমন্বয়ে বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নে ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) নির্ধারণ করা হয়। সেখানে বিশ্বের সামগ্রিক উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট ৮টি গোল এবং ৬০টি ইনডিকেটর নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শুধুই অঙ্গীকারাবদ্ধই নয়, হেলথ পপুলেশন নিউট্রিশান সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এইচপিএনএসডিপি) ২০১১-২০১৬ এর আওতায় মা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মযজ্ঞও হাতে নিয়েছে।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি)- এর ৮টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দু’টি অর্থাৎ ৪ ও ৫ নম্বর গোলটি সরাসরি মা ও শিশু স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল-৪ হচ্ছে, শিশুমৃত্যুর হার কমানো। ২০১৫ সালের মধ্যে শিশুমৃত্যু কমানোর জন্য বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু প্রতি হাজার জীবিত জন্মের মধ্যে ৪৮ এ নামিয়ে নিয়ে আসা, নবজাতকের মৃত্যু প্রতি হাজার জীবিত জন্মের মধ্যে ৩১ এ নামিয়ে নিয়ে আসা এবং ইপিআই মিজেলস ভ্যাকসিন প্রদানের হার শতভাগ অর্জন।
একইভাবে ৫নং মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল হচ্ছে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর প্রতি ১ লাখ জীবিত জন্মের মধ্যে ১৪৩ এ নামিয়ে নিয়ে আসা, দক্ষ প্রসবকারীর দ্বারা ৫০ শতাংশ ডেলিভারি করানো, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৭২ শতাংশ করা, কিশোরী মায়ের শিশু জন্ম হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসা, গর্ভবতী মায়ের কমপক্ষে একবার চেকআপ করানোর হার শতভাগ করা, গর্ভবতী মায়ের কমপক্ষে চারবার চেকআপ করানোর হার ৫০ শতাংশ করা এবং পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা ৭.৬ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসা।
এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সরকারের একার পক্ষে সীমিত সময়ের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন। তাই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ এগিয়ে নিয়েছে সরকারের উদ্দেশ্যকে। সরকার-বেসরকারি সমন্বিত এসব নানামূখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে অর্জিত হয়েছে ব্যাপক সফলতা যা সারা বিশ্বে এখন আলোচিত বিষয়।
সরকার সীমিত সম্পদের মধ্য থেকেও স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাতে সফলতা অর্জিত হয়েছে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট প্রজনন হার অর্থাৎ প্রত্যেক দম্পতি গড়ে ২.৩ জন করে সন্তান জন্ম দেন। বরগুনা জেলায় এ হার ১.৩ জন, যা বাংলাদেশের সকল জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ অর্জন।
তবে আমাদের অর্জন যেমন অনেক বেশি তেমনি কাজ করার এখনো অনেক কিছু বাকি।
বাংলাদেশ বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে এখনও মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত। মাতৃসেবার উন্নয়ন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার অগ্রাধিকার রেখে বহুলাংশে খাতভিত্তিক তথা বিভিন্ন সেবার বাজেট বরাদ্দ রেখেছে। অধ্যাপক বারাকাত এর গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৮৫ শতাংশ মহিলা এখনও চিরাচরিত ধাত্রীদের দিয়ে নিজ ঘরে প্রসব করিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে মা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে বরগুনা সদর উপজেলার কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যে গৌরীচন্না ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পর পর দু’বার নিরাপদ প্রসব সেবা দানের জন্য ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বরিশাল বিভাগের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় এলসিবিসিই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় গত বছরের শেষদিকে বরগুনার আয়লাপাতাকাটা ইউনিয়ন পরিষদ মা ও শিশুদের উন্নয়নে বাধাগুলো চিহ্নিত করে। এতে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা সদর হাসপাতালে আনতে পরিবহন সংকটের বিষয়টি উঠে আসে।
এতে বলা হয়, পরিবহন সংকটের কারণে অনেক মায়েরা সময়মতো চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেন না। এতে অনেক মা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং এর ফলে মাতৃস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে।
আয়লাপাতাকাটা, ফুলঝুড়ি, নলটোনা, বুড়িরচর ও এম বালিয়াতলী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নিরাপদ ডেলিভারি সেবার জন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নিজ নিজ এলাকার মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে তাদের পরিষদ থেকে একটি করে রিকশা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছেন, যা এলাকার মানুষের মনে আশা জাগিয়েছে।
রোগীদের আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করে দেশীয় প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এ ধরনের অভিনব মোটর অ্যাম্বুলেন্সের সূচনা করা হয়। এর নামকরণ করা হয়েছে গ্রামীণ মোটর অ্যাম্বুলেন্স(হাসি)। শুধুমাত্র গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েদের আনা-নেওয়ার কাজে নতুন উদ্ভাবনী এ গ্রামীণ মোটর অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নিরাপদ প্রসব সেবার এ নতুন মাত্রা যোগ করায় বরগুনা সদর উপজেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
স্থানীয় অবস্থান ও প্রকৃতি বিবেচনা করে টেকসই সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন ধরনের সম্প্রসারিত উদ্ভাবনী সেবার অবদান অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে হাসি নামক এ প্রযুক্তির পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে দুই তৃতীয়াংশ সড়ক কাঁচা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত সেখানে গ্রামীণ মোটর অ্যাম্বুলেন্স (হাসি) নির্বিঘ্নে অল্প সময়ে বিনা ভোগান্তিতে প্রসবকালীন মাতৃসেবা পৌঁছাতে সক্ষম।
স্থানীয় পর্যায়ে এর কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ফলে যন্ত্রাংশ সহজলভ্য এবং মেরামত ও সংস্কার করা সহজ।
ইউনিয়ন পর্যায়ে মাতৃসেবার নিশ্চিত করাসহ নারীর অকাল প্রজনন, প্রসব ও প্রসবোত্তর জটিলতা, শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধি ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মদানের মতো বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ লাঘব করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মাঠ পর্যায়ে বর্তমান সার্বিক অবস্থার শিক্ষা, যোগাযোগ, সম্পদের প্রতুলতা ও অবকাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি মানসম্মত প্রসবকালীন সেবার জন্য গ্রামীণ মোটর অ্যাম্বুলেন্স হাসি সেবার মূর্ত প্রতীক, ইতোমধ্যেই যা স্থানীয়ভাবে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে।
গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, বরগুনা সদর, বরগুনা
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৫