ঢাকা: এমনকি সহনীয় (মডারেট) মাত্রার আর্সেনিক শরীরে গেলেও তা হৃদযন্ত্রের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে, ধূমপায়ীদের জন্য তা বেশি বিপদের হয়ে দাঁড়ায়।
এটাই এ ধরনের প্রথম সমীক্ষা। এতে হৃদসংক্রান্ত রোগের (কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ) সঙ্গে সহনীয় মাত্রার আর্সেনিক গ্রহণের সম্পর্ক পরিমাপ করা হয়েছে। আর ধূমপান ও আর্সেনিকে আক্রান্ত হওয়া একযোগে এই দুইয়ের প্রতিক্রিয়ায় হৃদযন্ত্রের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। সমীক্ষা থেকে প্রথমবারের মতো এমন সিদ্ধান্তও টানা হয়েছে।
সমীক্ষা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের শিক্ষক ড. ইউ চেন।
ড. চেন ব্যাখ্যা করে বলেন, এর আগের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পানিতে উচ্চমাত্রার (প্রতি লিটারে ৫০০ মাইক্রো গ্রাম) আর্সেনিকের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচলে বাধাসহ নানা ধরনের হৃদসংক্রান্ত সমস্যা জড়িত। তিনি আরও বলেন, ‘এটা এখন প্রমাণিত, স্বল্প (১০০ মা.গ্রা.) বা সহনীয় (৩০০ মা. গ্রা.) মাত্রার আর্সেনিক শরীরে প্রবেশ করলেও মৃত্যুহার বাড়ে। এ নিয়ে কাজ শুরু করার সময় আমাদের গবেষণায় দেখাতে চেয়েছিলাম, পানির সঙ্গে আর্সেনিক শরীরে গেলে অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের তা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ’ ড. চেন ও তার সহকর্মীরা গত ৫ মে তাদের গবেষণাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন।
গবেষণা সন্দর্ভটির আরও দুই লেখক ড. অ্যালান এইচ স্মিথ (ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যায়, বার্কেলে) ও ড. ক্রেইগ এম স্টাইনমুস (এনভায়রনমেন্টাল হেলথ হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্ট, অকল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া) বলেন, ‘পানিতে মিশ্রিত আর্সেনিক স্বাদহীন এবং তা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ দেখায়। সেই পানি সেদ্ধ করলেই কেবল আর্সেনিকের উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে। ’ চেন ও তার সহকর্মীদের গবেষণায় হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে মৃত্যুহার বাড়ে--এমন গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গবেষণায় বলা হয়, ‘বিশ্বের সব অঞ্চলে ভূতলের পানি খাওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসকদের উচিৎ তাদের রোগীদের জিজ্ঞাসা করা, খাওয়ার পানি তিনি কোথায় পেয়েছেন। ওই পানি যদি কূপ থেকে আসে, তাহলে জিজ্ঞেস করতে হবে তা আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে কি না। না করা থাকলে তা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া উচিৎ। ’
ড. ইউ চেন বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে আর্সেনিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দরিদ্র দেশে এটা হচ্ছে না। এখানে ভূতলের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ’
দলগত গবেষণাটি ড. চেন ও তার সহকর্মীরা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় পরিচালনা করেন। এ উপজেলার আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটার। পাঁচ হাজার ৯৬৬টি কূপ থেকে পানির নমুনা ও এর ভূতাত্ত্বিক পরিমাপ (জিওগ্রাফিকাল কোঅর্ডিনেটস) নেওয়া হয়। ২০০০-এর অক্টোবর থেকে ২০০২-এর মে পর্যন্ত স্থানীয় ১১ হাজার ৭৪৬ জন বিবাহিত ও বয়স্ক নারীপুরুষকে সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের সবাই অন্তত পাঁচ বছর ধরে ওই এলাকায় বসবাসরত। আর একজন ব্যক্তি অন্তত তিন বছর ওই কূপ ব্যবহার করেন।
সশরীরে গবেষণা দলের সদস্যরা দুই বছর অন্তর ওই স্থান পরিদর্শনে যান। এসময় স্থানীয় অধিবাসীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক তাদের সাক্ষাৎকার নেন। এই সমীক্ষায় প্রথম দফা (২০০২ থেকে ২০০৪ সাল) এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় (২০০৭ থেকে ২০০৯) দফায় নেওয়া সাক্ষাৎকারের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। আর্সেনিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সমীক্ষায় পানি ও প্রস্রাবের পরীক্ষা চালানো হয়।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের শরীরে আর্সেনিকের মাত্রা শূন্য দশমিক এক থেকে ৮৬৪ মাইক্রো গ্রাম (প্রতি লিটার) পাওয়া যায়, যা গড়ে ৯৯ মাইক্রো গ্রাম। ড. ইউ বলছেন, ‘স্বল্প বা সহনীয় মাত্রার আর্সেনিকের ফলেও হৃদসংক্রান্ত নানা সমস্যা হতে পারে, এখন আমরা এরকম সিদ্ধান্ত টানার সূত্র পেয়ে গেলাম। ’
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলো তাদের আদর্শ মানদ- বেঁধে দিয়ে পরামর্শ দিয়েছে, ১০ মাইক্রো গ্রাম (প্রতি লিটার) আর্সেনিকযুক্ত পানি গ্রহণ করা যাবে।
স্মিথ ও স্টাইনমুস তাদের নিবন্ধে বলছেন, আরও বিস্তৃত পরিসরে কূপগুলো পরীক্ষা করা দরকার, যাতে লোকজন বুঝতে পারে কোনগুলো নিরাপদ। তাদের মতে, ‘জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারণ সারা বিশ্বেই ভূতলের পানিতে আর্সেনিক আছে। অন্যান্য পরিবেশগত হুমকির চেয়ে আর্সেনিকের ঝুঁকি অনেক বেশি। উচ্চমাত্রার আর্সেনিকযুক্ত পানি গ্রহণ করে ১০ জনে একজন লোক মারা যায়। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৩ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১১