ঢাকা, সোমবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ জুলাই ২০২৪, ২৩ জিলহজ ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

‘কৃত্রিম’ সঙ্কটে জর্জরিত কুমেক হাসপাতাল

ইমতিয়াজ আহমেদ জিতু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৯ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৫
‘কৃত্রিম’ সঙ্কটে জর্জরিত কুমেক হাসপাতাল

কুমিল্লা: এক দিকে যন্ত্রপাতির অভাব, অন্যদিকে চিকিৎসক এবং কর্মচারীদের তৈরি করা কৃত্রিম সঙ্কট- সব মিলিয়ে অনেকটা ঢিমেতালে চলছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। কম খরচে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে অনেক রোগী ও তাদের স্বজনরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।



নগরীর কুচাইতলীতে অবস্থিত ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে চলছে এরকম নানা অনিয়ম। গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতির অভাব, নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা যন্ত্রপাতি কৃত্রিম সঙ্কটের কারণে  প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা।

দেড় বছর ধরে নষ্ট ডিজিটাল এক্সরে মেশিন
কুমেক হাসপাতালের ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি গত দেড় বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। যার ফলে রোগীরা স্বল্প মূল্যে এক্সরে সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কুমেক সূত্র জানায়, প্রায় ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ডিজিটাল মেশিনটি স্থাপনের পর থেকেই কোনো এক্সরে করা যায়নি। মেশিনটি নষ্ট হয়ে আছে শুরু থেকেই।

এ মেশিনটি নষ্ট হওয়ার ফলে হাসপাতালে ভর্তি গুরুতর অসুস্থ রোগীরাও স্ট্রেচারে করে হাসপাতালের বাইরের প্রাইভেট হাসপাতালে এক্সরে করানোর জন্য যেতে হয়। আবার অনেক সময় স্ট্রেচার না পেলে দু’জনের কাঁধে ভর করেও রোগীদের নিতে দেখা যায়। যার ফলে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীদের।

এবিষয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অভিযোগ, বাইরের কিছু প্রাইভেট হাসপাতালকে সুবিধা দিতে এক শ্রেণির সুবিধাভোগী চিকিৎসক ও কর্মচারী মেশিনটি ঠিক করেত দিচ্ছেন না।

কুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাবিব আব্দুল্লাহ সোহেল বাংলানিউজকে জানান, এ বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার জানিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসে সার্ভেও করে গেছে। এখন অপেক্ষা করতে হবে।

কালার ডপলার মেশিন নিয়ে নানা হয়রানি
কুমেক হাসপাতালের ভেতরে ইর্মাজেন্সি ভবনের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত পরমাণু ও আল্ট্রাসাউন্ড কেন্দ্রেও কালার ডপলার মেশিন নেই বলে অনেক রোগীকে প্রতিনিয়ত ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

বুড়িচংয়ের বাসিন্দা নাফিজা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, আমার রোগের পরীক্ষার জন্য পরমাণু ও আল্ট্রাসাউন্ড কেন্দ্রে গেলে সেখানে কর্মরত একজন আমাকে প্রাইভেট হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে জানান, এখানে কালার ডপলার মেশিন নেই।

কিন্তু কুমেক পরিচালক ডা. হাবিব আব্দুল্লাহ সোহেল বাংলানিউজকে এ বিষয়ে জানান জানান, যদিও এ বিভাগটি আমাদের হাসপাতালের আওতাভুক্ত নয়। তবে এখানে কালার ডপলার মেশিন রয়েছে বলে আমি জানি।

ল্যাপারোস্কপি মেশিন উন্নত মানের নয়!
কিডনিতে পাথর রয়েছে এমন রোগী কুমেক হাসপাতালে গেলে ডাক্তাররা প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের নিরাশ করে কুমিল্লার কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে বলে। ডাক্তাররা অনেক সময় রোগীদের বলে এ মেশিন নষ্ট। আবার অনেক ক্ষেত্রে বলে মেশিন আছে, তবে তা উন্নত মানের নয়। আপনার যে গভীর সমস্যা তাতে এ মেশিন দিয়ে অপারেশন সম্ভব নয়। আপনি প্রাইভেট হাসপাতালে চলে যান!

মুরাদনগর উপজেলার বাসিন্দা সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বাংলানিউজকে জানান, আমার শাশুড়ির কিডনিতে পাথর হয়েছিল। আমি এ বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য ইউরোলজির প্রধান বিশেষজ্ঞ ডা. সিরাজুল ইসলামের কাছে যাই। তিনি আমাকে বললেন, কুমেকের ল্যাপারোস্কপির মেশিন অতটা উন্নত মানের নয়। এত ভেতরে প্রবেশ করিয়ে পাথর সরানো সম্ভব নয়। হয় আপনার রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে, নতুবা কুমিল্লার প্রাইভেট হাসপাতালে (একটি প্রাইভেট হাসপাতালের নাম বলে) নিয়ে যান। সেখানে ভালো ল্যাপারোস্কপির মেশিন রয়েছে।

ওই প্রাইভেট হাসপাতালে গেলে জানা যায়, ডা. সিরাজুল ইসলামই এ অপারেশনটি করবেন। এ হাসপাতালে অপারেশন করলে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা লাগবে। সেখান থেকে ওই ডাক্তার পাবেন কমপক্ষে ৪৫ হাজার টাকা। এছাড়া অনেক রোগী এ ধরনের অভিযোগ করলেন। ওই প্রাইভেট হাসপাতালের কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছে, কুমেক হাসপাতালে যে মেশিনটি রয়েছে তা দিয়ে অপারেশন সম্ভব।

কুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাবিব আব্দুল্লাহ সোহেল বাংলানিউজকে জানান, হয়ত এ মেশিনটি গভীরতম স্থানে প্রবেশ করে পাথর সরাতে সক্ষম হবে না, তাই ডাক্তার এ পরামর্শ দিয়েছেন।

প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে বলার কারণ
কিডনিতে পাথর রয়েছে এমন রোগীদের সরকারি হাসপাতালে অপারেশনে ওষুধপত্র ছাড়া তেমন আর কিছু লাগে না। এ ক্ষেত্রে সার্জন চিকিৎসকরা অপারেশন বাবদ রোগীদের কাছ থেকে ফি নিতে পারেনা। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালে এমন ধরনের রোগী অপারেশন করলে প্রায় ৭০/৮০ হাজার বিল আসে। এক্ষেত্রে একজন ডাক্তার প্রায় ৫০ হাজার টাকা পায়। তাই সরকারিতে না রেখে প্রাইভেটেই রোগীদের স্থানান্তর করতে পচ্ছন্দ করে কিছু কিছু ডাক্তাররা।

বেশির ভাগ রোগীই এমআরআই মেশিনে সেবা পান না
কুমেক হাসপাতালের নতুন ভবনের নিচতলায় স্থাপিত মেরুদণ্ডের সমস্যা জনিত রোগের (ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত মেরুদণ্ডের ব্যথা) এম আর আই মেশিনটিতে সাধারণ মানুষেরা তেমন সেবা পায় না বললেই চলে। এ মেশিনে মূলত প্রতিদিন সেবা পাচ্ছে ২/৩ জন রোগী, তাও আবার সরকারি ফি ৩ হাজার টাকা দিয়েও বাড়তি ঘুষ দিতে হয় টেকনোলজিস্ট মামুনকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমেকের একাধিক সূত্র জানায়, টেকনোলজিস্ট মামুনকে বাড়তি টাকা না দিলে রোগীদের নগরীর ঝাউতলা সিটি স্ক্যান সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। শহরের বাইরের অনেক রোগীকেই প্রতিদিন নিরাশ হয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে সাড়ে ৬ হাজার টাকা দিয়ে এমআরআই করাতে হয়। আবার অনেক রোগীকে মেরুদণ্ডের ব্যথা নিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে হয়।

সূত্র জানায়, প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী পাঠালে সেখান থেকে একটা কমিশন প্রেরকের পকেটে আসে।

এ বিষয়ে কুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাবিব আব্দুল্লাহ সোহেল বাংলানিউজকে জানান, ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। মানুষ তো এখান থেকে সেবা পাচ্ছে।

এক বছর ধরে নষ্ট সিটি স্ক্যানের পিকচার টিউব
কুমেক হাসপাতালের সিটি স্ক্যানের পিকচার টিউব গত এক বছর ধরে নষ্ট হয়ে আছে। এটি কিনতে খরচ হবে প্রায় ৬০ লাখ টাকা। মাঝে-মধ্যে এমআরআই মেশিন দিয়ে সিটি স্ক্যানের কাজ চালানো হয়। সিটি স্ক্যান মেশিনটি নষ্ট হওয়ায় রোগীরা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে। এখানে সিটি স্ক্যান না করাতে পেরে রোগীদের কুমিল্লার প্রাইভেট হাসপাতালে ছুটে যেতে হয়। আর সেখানেই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সিটি স্ক্যান করাতে হয়। আর প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে গরীব-অসহায় রোগীরা নিঃস্ব হয়ে বাড়িতে ফিরে যায়।

কুমেক হাসপাতালে মূলত গরীব-অসহায় বড়জোর মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনরাই স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসার জন্য আসে। কিন্তু যন্ত্রপাতি না থাকা, আবার বিকল হয়ে পড়ে থাকায়, অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অদৃশ্য যোগসাজোশ থাকায় ডাক্তাররাই রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে যেতে বাধ্য করে। ফলে স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সিংহভাগ রোগী।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৫
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।