ঢাকা: ‘এক ঢিলে দুই পাখি’র মতো ‘এক গুলিতে মা-শিশু নিহত’- এমন শিরোনামে শেষ হতে পারতো খবরটি। কিন্তু ‘মাগুরায় মায়ের গর্ভে শিশু গুলিবিদ্ধ’ শিরোনামটি ক্রমশ বদলে গেছে; জন্ম দিয়েছে একটি ইতিহাস, একটি সাফল্যের গল্পের।
![](files/dmc_1_935381149.jpg)
এ গল্পটি একদিকে চিনিয়েছে কিছু মানুষরূপী পশুকে, যারা ২৩ জুলাই গুলি চালিয়েছে এক নিরীহ গর্ভবতী নারীর ওপর; তার চেয়েও ভালো করে চিনিয়েছে কিছু মানুষরূপী দেবদূতকে, যারা নিজেদের উজাড় করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন আহত মা-শিশুর। তাদের চেষ্টায় ২০ আগস্ট শিশু সুরাইয়া ঘরে ফিরেছে মায়ের কোলে, বোন সুমাইয়া ও ভাই সাগরের কাছে।
![](files/dmc_banglanews24_400285765.jpg)
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এ মহাপ্রাণ চিকিৎসকরা বাংলানিউজকে শোনালেন তাদের তৃপ্তির গল্প, ব্যস্ত সে সময় ও অভিজ্ঞতার কথা।
![dmc_08 dmc_08](files/August2015/August23/dmc_08_642722462.jpg)
‘এক্সিলেন্ট, ডেডিকেটেড, এমপ্যাথেটিক’ টিম
একা কোন কৃতিত্বের দাবি করছেন না তারা কেউই। সবাই প্রশংসা করছিলেন মাগুরা সদর হাসপাতালের শল্যচিকিৎসক শফিউর রহমান ও তার দলের।
![Suriya_02 Suriya_02](files/August2015/August23/Suriya_02_656996669.jpg)
তারা বলছেন, এ সাফল্য একটি ভালো টিমওয়ার্কের ফল। ‘এক্সিলেন্ট, ডেডিকেটেড, এমপ্যাথেটিক’ ছিল টিমটি। বিভাগগুলো স্বতস্ফূর্তভাবে কাজ করেছে। গুলিবিদ্ধ শিশুটিকে মাগুরায় জরুরিভাবে শল্যপ্রসবে বের করা, দ্রুত ঢাকা স্থানান্তর, অতি দ্রুত সময়ে যা যা প্রয়োজন তার সবটুকু ব্যবস্থা করা, ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড, তারও বাইরে নিজ উদ্যোগে সবার এগিয়ে আসা, বিএসএমএমইউ থেকে দুই দফায় বড় চিকিৎসকদের পরামর্শ দিতে আসা- প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত, সেই সঙ্গে দারুণ ছন্দও।
চিকিৎসকদের বর্ণনায় ঘটনা প্রায় একইরকম, চোখগুলোই কেবল ভিন্ন।
প্রতি মুহূর্তেই চ্যালেঞ্জ ও মৃত্যুঞ্জয়
![dmc_05 dmc_05](files/August2015/August23/dmc_05_321845275.jpg)
‘নির্দিষ্ট সময়ের ৬/৭ সপ্তাহ আগেই এ শিশুর জন্ম। প্রথমে কাঁদছিল না, শ্বাস নিচ্ছিল না। ওজন ২ কেজিরও কম। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে তৃতীয়দিনে ঢাকা আনা হয়। প্রথমে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ৪র্থ দিন ভোরে এখানে আসেন তারা’- আলাপের শুরুতেই বলেন নবজাতক বিভাগের প্রধান আবিদ হোসেন মোল্লা।
তার বিভাগে ভর্তি নবজাতকদের দেখালেন এ ফাঁকে, সুরাইয়ার সে কাচের ঘরটিও। উঁকি দিয়ে দেখা যায়- চিকিৎসকরা ব্যস্ত সেবাদানে। একসঙ্গে ৩৪ নবজাতককে সম্পূর্ণ বিনাব্যয়ে সেবা দেন তারা।
নবজাতক বিভাগে আনার আগে শিশুটি ছিল শিশুসার্জারি বিভাগে, সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলীর কাছে। সুরাইয়ার জন্য মানত করেছিলেন এ চিকিৎসক। বাড়ি ফেরার আগে মেয়ের বাবা বাচ্চু ভূঁইয়ার হাতে গুঁজে দেন নগদ ৬৫ হাজার টাকা, যা তিনি আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
![dmc_02 dmc_02](files/August2015/August23/dmc_02_932922893.jpg)
ব্যক্তিগত জীবনে দু’সন্তানের জননী এ মমতাময়ী বলেন, ২৬ জুলাই চারদিন বয়সে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আমরা পাই শিশুটিকে। কর্তব্যে ছিলেন শিশুসার্জন ডা. সদরুদ্দিন আল মাসুদ। ডান বুকের সামনে-পেছনে, ডান হাতে-গলায়, ডান চোখে বুলেটের আঘাত পাওয়া শিশুটি মাগুরা থেকে এদ্দুর জার্নিতে এসেছে। তার অবস্থা বেশ নাজুক তখন। শরীর উষ্ণ রাখতে তুলা পেঁচিয়ে দেওয়া হল তাকে, সঙ্গে রুমহিটার, খাবারের যোগানে চলছে স্যালাইন।
তার ইনজুরিগুলোর এক্সরে নেওয়া হল, অর্গানগুলো ম্যাচিউরড হয়নি। রিস্কও তাই খুব বেশি। সবচে বড় বিপদ হবে এ অবস্থায় কোন সংক্রমণ হলে। তাই তাকে সবার নাগালের বাইরে রাখা হল। শুধু চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তার কাছ ঘেঁষতে পারবেন।
![dmc_03 dmc_03](files/August2015/August23/dmc_03_895342902.jpg)
এরপরই আবিদ হোসেনকে প্রধান রেখে ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড হল। শিশু সার্জারি প্রধান অধ্যাপক মো আশরাফ উল হক (কাজল), একই বিভাগের অধ্যাপক মো. আব্দুল হানিফ (টাবলু), কানিজ হাসিনা শিউলী, থোরাসিক সার্জারির সহযোগী অধ্যাপক কামরুল আলম, চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ফরিদুল হাসান, প্লাস্টিক সার্জারি’র সহযোগী অধ্যাপক ডা. নওয়াজিশ খান, অর্থোপেডিক’র সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা, কার্ডিওলজি’র প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের প্রধান ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মতো বাঘা বাঘা ডাক্তার মনোযোগ ঢেলে দিলেন ‘একটি ফুলকে’ বাঁচাবেন বলে।
সুরাইয়ার হাসপাতাল সময়ের ২৬ দিনের মধ্যে ২৩ দিনই এখানে ছিল। চিকিৎসক, নার্সরা ডিউটির নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও সময় দিয়েছেন।
![dmc_04 dmc_04](files/August2015/August23/dmc_04_867877004.jpg)
শিশু সার্জন সিফাতের মন কাঁদে সুরাইয়ার জন্য। পত্রিকায় আসা ছবিগুলো খুটিয়ে দেখেন। তার দেওয়া মশারি, লেপ, কাথা, বালিশ এখন সুরাইয়ার কাছে।
ওয়ার্ডবয় রাজু তো সুরাইয়াকে দুবার রক্ত দিয়ে নিজেকে তার রক্তের আত্মীয় মনে করছেন। স্ক্যাবু ইনচার্জ সিস্টার জয়ন্তী ঘাগড়া, সুলতানা পারভীনের মুখে এখনো সেই শিশুর গল্প। সংক্রমণ এড়াতে এ দু’জন তাদের উর্ধ্বতনদেরও বকে দিয়েছেন কখনো কখনো।
আনার পর থেকেই সুরাইয়ার বার বার রক্ত পরীক্ষা হচ্ছিল। ২৯ জুলাই সার্জারির দিন পাওয়া ফলাফলে দেখা গেল- শিশুর রক্তে অনুচক্রিকা মাত্র ৫ হাজার, থাকার কথা দেড় লাখ। এ তারতম্যে সংক্রমণ ও রক্তপাতের আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। শিশুর জন্ডিস ১৭, থাকার কথা ১৩। লিভারসহ অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপরিপক্ক। আরও সতর্ক হন ডাক্তাররা।
![dmc_09 dmc_09](files/August2015/August23/dmc_09_117773125.jpg)
ডায়াপার, তুলা, রুম হিটার দিয়ে তাকে উষ্ণ রাখছিলেন শিউলীরা, সবার কাছ থেকে আলাদাও। কিন্তু এসব যথেষ্ট নয় নিরাপত্তায়। প্রয়োজন ওয়ার্মার ও ফটোথেরাপি। তাই ২৮ জুলাই নিজের নবজাতক বিভাগে এনে অন্য শিশুদের থেকেও সুরাইয়াকে আলাদা করে রাখলেন আবিদ।
সুরাইয়ার শরীরে পানি দেখা দিল, প্রোটিন-অ্যালবুমিন কম। ঘাটতি দূর করতে তাই ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। পরদিন সকালে অবস্থার উন্নতি হয়। তার জন্য সর্বোচ্চ মানের অ্যান্টিবায়োটিক ম্যানেজ করলেন ডাক্তার। স্যালাইন চলছিল প্রথম থেকেই। কোন মায়ের দুধ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে টিনের দুধ দেওয়া হচ্ছিল পুষ্টির জন্য। সুরাইয়ার হজম হল না, বমি করে দিল। তাই দুদিন দুধ দেওয়া বন্ধ।
![dmc_01 dmc_01](files/August2015/August23/dmc_01_771860407.jpg)
এর মধ্যে টের পাওয়া গেল তার হৃদযন্ত্রের শব্দের সঙ্গে অন্যরকম একটি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেল, হৃদযন্ত্রে একটি ছোট্ট ছিদ্র রয়েছে, যা জন্মের ৭ সপ্তাহ আগে হয়েছে। বিএসএমএমইউ’র চিকিৎসকদের সহায়তায় সে চিকিৎসাও হল, সমস্যা মিটলো।
নাজমাকে ঢাকা আনা হয়, দায়িত্ব নেন স্ত্রীরোগ ও প্রসুতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. নীলুফার সুলতানা। মায়ের দুধ নলে করে সুরাইয়াকে দেওয়া হচ্ছিল।
২৬তম দিন থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় শিশুকে দুধ দেওয়া হতে থাকলো। এক এমএল, দুই এমএল করে ক্রমশ বাড়িয়ে এক সময় দেখা গেল ২৫ এমএল পর্যন্ত প্রতি দু’ঘণ্টায় তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে। স্যালাইন দেওয়ার আর প্রয়োজন রইলো না। তার ওজনও বাড়তে থাকে। ১৮শ’ গ্রাম ওজনের সুরাইয়া বিদায়ের সময় ২১৫০ গ্রাম হয়ে ফিরেছে- জানান শিউলী।
![dmc_10 dmc_10](files/August2015/August23/dmc_10_954338085.jpg)
এক সময় শিশুটি ঠোঁট নাড়ায়, ডাক্তার বোঝেন, এবার সে মায়ের দুধ নিজেই চুষে খেতে পারবে। ওয়ার্মারও আর প্রয়োজন হচ্ছে না।
নাজমার শরীরে ছত্রাক-সংক্রমণ থাকায় সুরাইয়াকে প্রথম দিকে তার কোলে দেওয়া হয়নি। ২৫তম দিনে দেওয়া হয়, কিন্তু আশঙ্কাও সত্য হয়। মেয়েও আক্রান্ত হল সংক্রমণে। দুজনের চিকিৎসাই দিতে থাকেন ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। নিজের পা দেখিয়ে তিনি হাসেন, ‘পায়ে ফ্রাকচার, এটা নিয়েই প্রতিদিন সিঁড়ি বেয়েছি। ’
ডা. আশরাফ বলেন, আসলে মা-মেয়ে একে অন্যকে বাঁচিয়েছে। সন্তান গর্ভে থাকায় মায়ের আঁতসহ অন্য অর্গানগুলো ওপরে উঠে গেছে। তাই বুলেট অর্গানগুলোর ক্ষতি করতে পারেনি। এদিকে মায়ের জরায়ুতে থাকা পানির কারণে বুলেট ঘূর্ণন হারিয়েছে। ঘূর্ণনে যে ক্ষতি হত, তা হয়নি। এছাড়া শিশু যেহেতু মায়ের রক্ত থেকে অক্সিজেন নিচ্ছিল, ফুসফুস ছিল সংকুচিত। বুলেট পাশ দিয়ে চলে গেলেও ফুসফুস ছিদ্র হয়নি।
ডা. হানিফ ও ডা. শিউলী ব্যক্তিগত জীবনে দম্পতি। পত্রিকায় ছাপা হওয়া সুরাইয়ার হাসিমুখের ছবিটি মোবাইল ফোনে তোলেন হানিফ। সবকটা ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘এতগুলো ছবি তোলার পর বেটি হাসলো। ’
![dmc_07 dmc_07](files/August2015/August23/dmc_07_946576335.jpg)
কাজ কিছু বাকি
এ ঘটনার রেশে ভবিষ্যতে মায়ের কোন সমস্যার আশঙ্কা করছেন না ডা. নীলুফার। তবে সুরাইয়ার চোখের চিকিৎসাটি সুদূরপ্রসারি হবে বলছেন ডা. ফরিদ।
![](files/dmc_24_696904542.jpg)
তিনি বলেন, ডানচোখটি কখনোই আর বামচোখের মতো হবে না। কিন্তু আমরা কখনোই আশা ছাড়ি না। ওর চিকিৎসা চলবে। আগারগাঁও চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হবে। জন্মের ৬ সপ্তাহ পর শিশুর চোখে ভিশন আসে, ৬ মাস পর দৃষ্টিতে নির্দিষ্টতা যোগ হয়, সাড়ে ৪-৬ বছরে দৃষ্টির পূর্ণতা আসে। সুতরাং সুরাইয়ার চোখ এ সময়গুলোতে কীভাবে কাজ করছে, সেটি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
হানিফ বলেন, ‘শুনলাম, সুরাইয়াকে দেখতে বাড়িতে মানুষের ঢল নেমেছে। আমি সেখানকার প্রশাসক ও ডাক্তারদের ফোন দেব। বলবো- অন্তত তিনমাস ভিড় থেকে সুরাইয়াকে দূরে রাখতে। সংক্রমণ এড়ানোর মতো প্রতিরোধ ক্ষমতা তো শিশুটির এখনো হয়নি। ’
![Suraiya_bmch_2 Suraiya_bmch_2](files/August2015/August23/Suraiya_bmch_2_583097839.jpg)
অনন্য নজির
এ ঘটনাটি চিকিৎসাশাস্ত্রে উদাহরণ হিসেবে থাকবে বলছেন চিকিৎসকরা। কারণ বিশ্বে মা-শিশুর একসঙ্গে গুলিতে আহত হওয়ার ঘটনা যেমন বিরল, তেমনি দু’জনকেই বাঁচানোর নজিরও পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৫
এসকেএস/জেডএম