ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সঙ্গী চায় সরকার

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সঙ্গী চায় সরকার

ঢাকা: দেশে প্রতি ঘণ্টায় ১৭ জীবন কেড়ে নিচ্ছে মরণঘাতি ক্যান্সার। বছরে সংখ্যাটি দেড় লাখ ছাড়ায়।

ব্যয়বহুল চিকিৎসার এ রোগ মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেসরকারি উদ্যোগও চায় সরকার।  
 
এক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানান, রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলেই অবিলম্বে ক্যান্সার-ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে চায় সরকার, যেন রোগীরা সুচিকিৎসা পান, মৃত্যুর হার কমে আসে।
 
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে এমনই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বলছিলেন, সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সামগ্রিকভাবেই এ ভয়ঙ্কর রোগ মোকাবেলা করতে চাইছে সরকার।
 
ক্যান্সার শনাক্ত করা ও চিকিৎসার সরঞ্জাম, কেমোথেরাপির ব্যয় সংকোচন ও ব্যবহৃত ড্রাগগুলো দেশে সুলভ করা, রোগের শুরু থেকেই করণীয়গুলো নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, রেডিওথেরাপি মেশিন পর্যাপ্ত সংখ্যায় বাড়ানো, গ্রাম পর্যায়ে স্ক্রিনিং পদ্ধতি পৌঁছে দেওয়া, প্রশিক্ষিত অধিক সংখ্যক অনকোলজিস্ট নিয়োগ রাখার বিষয়ে সহযোগিতা চায় সরকার।  
 
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ক্যান্সার সচেতনতা বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়গুলোতে বেশ মনোযোগ দিচ্ছেন বলেও জানান মন্ত্রী। অন্যদেরও সহযোগিতা চাইছেন তিনি।
 
মন্ত্রী বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসার সক্ষমতা বাড়াতে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু শুধু সরকার নয়, ক্যান্সার মোকাবেলায় বেসরকারি অনেক উদ্যোগ প্রয়োজন। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
 
‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি উদ্যোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে’- উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসায় বেসরকারি খাত শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, বরং মানবসেবার লক্ষ্যে এগোবে- এটাই চাই।
 
সরকারি উদ্যোগ বাড়ানোর কথা জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হক।
 
তিনি বলেন, সরকার ক্যান্সার চিকিৎসায় সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের লোকবল বাড়ানো হয়েছে। সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে বিশেষায়িত হাসপাতালের মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রোগটি মোকাবেলায় ব্যবস্থাপনা পর্যাপ্ত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি আয়োজন চাইছি আমরা।
 
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে মার্কিন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রিচার্ড লাভও সার্বিক উদ্যোগের কথাই বলেন।
 
লাভ বলেন, এখানে সচেতনতা বাড়ানো, ভয় কাটানো, চিকিৎসা ব্যয় রোগীদের সামর্থ্যের মধ্যে আনা- এসব এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগীদের মানসিক সহযোগিতাও দেওয়া প্রয়োজন। সরকার আন্তরিক রয়েছে বলে মনে হয়েছে আমার। তবে যেকোনো বড় সমস্যা মোকাবেলায় সরকারকে সহযোগিতা দেওয়া উচিৎ অন্যদেরও। ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা মোকাবেলায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত্নবান হতে হবে।
 
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল ২০১০ সালের এক গবেষণার ফলাফল থেকে জানায়- দেশের ২১ শতাংশ মাতৃত্বকালীন মহাবিপদের পেছনের কারণ ক্যান্সার।
 
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস ২০০৮ সালে একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, দেশের ৬ষ্ঠ মরণঘাতি রোগ এটি।
 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র হিসেবে দেশে ১২ থেকে ১৪ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছেন। প্রতি বছর ২ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যান্সারে।
 
এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মোট মৃত্যুর ১২ দশমিক সাত শতাংশই ঘটবে ক্যান্সার ও ক্যান্সারজনিত কারণে- এমন আশঙ্কা জাতীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের।
 
এ গুরুতর বিপদ মোকাবেলায় সরকার ‘ন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোল স্ট্রাটেজি অ্যান্ড প্ল্যান অব অ্যাকশন ফর ২০০৯-২০১৫’ উদ্যোগ নিয়েছে ২০০৮ সালে। সেটি বাস্তবায়নেও চাই বেসরকারি সহযোগিতা।
 
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের হিসেব বলছে, ৬৬ শতাংশ রোগীর বয়স ৩০ থেকে ৬৫ বছর, যে বয়সীদের অধিকাংশই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন।
 
ক্যান্সার পরিস্থিতি বুঝতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে পাওয়া কিছু তথ্য উল্লেখ করা যায়।
 
স্তনক্যান্সার বিষয়ক গবেষণায় দেখা গেছে- রোগ শনাক্তে অনেক দেরি হয়। কারণ, ৫০ শতাংশ রোগী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেন, ২০ শতাংশ রোগী লক্ষণ দেখে স্বাভাবিক পরিবর্তন বলে ধরে নেন, ১৫ শতাংশ রোগী লজ্জায় কারও কাছে বলেন না, ১০ শতাংশ রোগী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক অসহযোগিতার কারণে আসেন না। আর বাকি ৫ শতাংশের পেছনে থাকে অন্য কারণ।
 
কাছাকাছি চিত্র অন্যান্য ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও- বলেন কর্মকর্তারা।
 
ক্যান্সার চিকিৎসক অধ্যাপক নিশাত বেগম বলেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মানুষকে কিছু বিষয়ে বোঝাতে হবে জোরেসোরে। যেমন- শুধুমাত্র কিছু অভ্যাস বদলে ৪০ শতাংশেরও বেশি ক্যান্সার থেকে বাঁচা যায়। তামাক-ধূমপানের অভ্যাস থেকে দূরে থাকা, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। বিষন্নতা, অবসাদ থেকে দূরে থাকতে হবে। মোট কথা- ভালো অভ্যাস গড়ে জীবনটাকে প্রতিমুহুর্ত উপভোগ করে ক্যান্সার থেকে দূরে থাকা যায়।
 
‘এতো গেল প্রাথমিক বিষয়। এরপর রোগ শনাক্ত থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সহযোগিতাও দিতে হবে তাদের। আর তাতে সামর্থ্যবানরা সরকারের পাশে থাকলে খুবই ভালো হয়’- বলেন তিনি।
 
ক্যান্সার এতোটা বাড়ার পেছনে দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, অপুষ্ট খাবার তালিকা এবং সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেন ডা. নিশাত।
 
ফুসফুস, জরায়ু, স্তনক্যান্সার, সেই সঙ্গে মুখ ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্যান্সারের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানান আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি’র অধ্যাপক কর্নেল (ডা.) সেলিনা আক্তার।
 
তিনি বলেন, কম বয়সীদের ক্যান্সার আক্রান্তের হার বাড়ছে বলে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। তাদের রোগটি থাকেও অনেক বেশি অ্যাগ্রেসিভ। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একসঙ্গে গুছিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার একা সামলে উঠতে পারবে না। এখন থেকে এ বিষয়ে পুরোদমে কাজ না করলে, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৫
এসকেএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।