ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--১

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৫
সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--১ ছবি: সংগৃহীত

[[ মাংসপ্রীতির ব্যাপারটি আছে মানুষের রক্তে আর জিনে। অল্প সংখ্যক সবজিভোজীর বাইরে মাংসপ্রীতি কমবেশি আমাদের সবার মধ্যেই আছে।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে নানান গবেষণায় বলা হচ্ছে, মাংসপ্রীতি ভালো নয় মোটে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা সম্প্রতি ব্যাপকভিত্তিক এক গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছে ক্যান্সারসহ নানা রোগের জন্য রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। আর এসব মাংসের সবচেয়ে বড় ভোক্তা আমেরিকানরা। এ নিয়ে টাইম ম্যাগাজিন তাদের চলতি সংখ্যায় ‘‘THE WAR ON DELICIOUS’’ শিরোনামে কভার স্টোরি করেছে। এরই সূত্র ধরে কনসালট্যান্ট এডিটর জুয়েল মাজহার লিখেছেন তিন পর্বের এই লেখাটি। পড়ুন প্রথম পর্ব]]

ঢাকা: আমেরিকানরা তাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা নিয়ে মুখে ফেনা তোলায় ওস্তাদ। বেশিরভাগ সময়েই তারা বেশ কিছু বহুচর্চিত বিষয় নিয়ে আসতে চায়----বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা ও যখন খুশি সমবেত হওয়ার অধিকারসহ নানান বিষয়। এটা তাদের দাদা-পরদাদারাও চাইতেন। তারা চাইতেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের বেলায় এসব বিষয় যেন কেন্দ্রে থাকে।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর বাইরেও আছে আরো কিছু বিষয় বা স্বাধীনতার প্রসঙ্গ। যেমন, উচ্চকণ্ঠ হবার স্বাধীনতা, নিজেদেরকে বৃহৎ ও পরাক্রমশালী হিসেবে তুলে ধরবার স্বাধীনতা; এবং সবকিছুর জন্য ক্ষুধার্ত হওয়া এবং সেই ক্ষুধার নিবৃত্তির স্বাধীনতা। এটা হচ্ছে গিয়ে রক-এন-রোল, সুপার বৌলস, টাল্লাডেগা আর রোডিওর (ষাঁড়ের পিঠে চড়ার খেলা) স্বাধীনতা। আস্ত একটা মহাদেশের পত্তন ঘটিয়েও লেলিহান ক্ষুধা তবু মেটেনি আমেরিকার।

পরে আলাস্কা ও হাওয়াইকে নিজের করে নেওয়ার মধ্যে ওদের স্বাধীনতার উদগ্র প্রকাশ তারা ঘটিয়েছে। এখানেই শেষ নয়। এর পাশাপাশি প্রতিদিনকার জীবনযাপনে ব্যক্তিস্বাধীনতার হরেক চাহিদাও কিন্তু আছে! বলতেকি, এর কোনো সীমা পরিসীমা নেই। আর তার চূড়ান্ত প্রকাশটা ঘটে আসলে খাবারের টেবিলে---মানে, যা ইচ্ছে খাওয়ার স্বাধীনতা। আমেরিকানরা যা-যা করতে ব্যর্থ হয় তা তারা পুষিয়ে নেয় খাবার টেবিলে ----ইচ্ছামতো খেয়েদেয়ে নিজের মনের ঝাল মিটিয়ে। এখানেই ভোগবাদের চরম রূপটা পাওয়া যায়। কী খায় তারা? কতো কিছুই যে খায় তার কি আর ইয়ত্তা আছে!

খাবারের লম্বা-চওড়া মেন্যুই বলে দেয় ভোজনপ্রিয় আমেরিকানরা আসলে খাবার কেনার বেলায় এক মুক্তহস্ত জাতি। তবে যা-যা  ওরা খায় সেসব কতোটা স্বাস্থ্যপ্রদ সেটাই বড় প্রশ্ন। ওদের মেন্যুতে প্রধান উপাদানটাই হচ্ছে গিয়ে রেডমিট আর প্রক্রিয়াজাতকৃত (প্রসেসজড) খাবার। হামবার্গার আর হটডগ, বিফ সান্ডউইচ রীতিমতো হয়ে উঠেছে আমেরিকানদের জাতীয় খাবার বা জাতীয় প্রতীকও।

মনে করিয়ে দিই, এ’দুটি খাবার জাতীয় প্রতীক হয়ে উঠেছিল আজ থেকে বহু আগে---গত শতকের ৬০-এর  দশকের মাঝামাঝিতে। ১৯৬৫ সালে জেমিনি-৩ এর নভোচারীরা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কক্ষপথে। তবে প্রিয় নভোচারীদের এটুকু অপরাধ আমেরিকানরা গায়ে মাখেনি। বরং জানাজানি হবার পর গোটা আমেরিকা প্রশ্রয়ের মুচকি হাসি হেসেছিল কেবল।

কিন্তু আমেরিকানদের জাতীয় প্রতীক হয়ে ওঠা রেডমিট আর প্রসেজড ফুড-প্রধান এসব খাবারের বিরুদ্ধে এখন সবাই বলাবলি করছেন। স্বাস্থ্য-সচেতনতার এই যুগে রসনাতৃপ্তির পাশাপাশি মানুষ এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকটাও দেখে থাকে। ডাক্তার, পাবলিক হেলথ অ্যাডভোকেটরা তো বটেই মায় জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা(WHO)---সবাই আমেরিকানদের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাসের সমালোচনায় মুখর। এটা তারা শুধু আমেরিকানদের মঙ্গলের কথা মাথায় রেখে করছেন না, বরং গোটা দুনিয়ার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই করছেন। না করে উপায়ও তো নেই। সারা দুনিয়ার দেশে দেশে আমেরিকানরা যে তাদের খাদ্য ছড়িয়ে দিয়েছে। হলিউড মুভি, জ্যাজ-র‌্যাপ, পপগান থেকে শুরু করে আমেরিকানদের পছন্দের খাবার সবকিছুই সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে পেয়ে গেছে ফেভারিটের তকমা। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার উদ্বেগটাও সে-কারণেই।
 


গত ২৬ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা আমেরিকানদের প্রিয় প্রসেসজড বা প্রক্রিয়াজাত খাবারকে ‘গ্রুপ ওয়ান কারসিনোজেন’ (Group 1 carcinogen) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কারসিনোজেন মানে যা থেকে ক্যান্সার হয়। অর্থাৎ, তারা রেড মিটকে ক্যান্সারের জন্যে এক নম্বর দায়ী বলে শনাক্ত করেছে। প্রক্রিয়াজাত খাবারকে এক নম্বরের কালপ্রিট হিসেবে চিহ্নিত হলেও রেড মিটও কম যায় না। রেড মিট বা লাল মাংসকে ফেলা হয়েছে ‘গ্রুপ-২এ’-তে (Group-2A)। এই গ্রুপে পড়ে সেইসব খাদ্য বা খাদ্য উপাদান যেগুলো খেলে ক্যান্সার হয় বলে জোর ধারণা করা হয়। এই ক্যাটাগরিতে খাদ্য ও খাদ্য উপাদানে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর নানা উপাদান থাকে। যেমন ধরুন, বিষাক্ত কীটনাশক বলে পরিচিত ডিডিটি (DDT),  রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে সবার কাছে কুখ্যাত মাস্টার্ড গ্যাস এবং ম্যালাথিয়ন নামে আরো একটা কীটনাশক।

তবে গ্রুপ টু বি, থ্রি ও ফোর (Group2b, 3, 4) এর আওতায় যেসব খাবার ও খাদ্য উপাদান পড়ে সেগুলোও সম্ভবত  ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বা কারসিনোজেনিক। তবে এগুলোকে কারসিনোজেনিক হিসেবে এখনও শনাক্ত করা বা নিখুঁতভাবে প্রমাণ করা যায়নি। তবে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে সন্দেহের তালিকায় আছে এদের নাম।

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার এই গ্রুপিংয়ের কারণে আমেরিকা-কানাডাসহ পশ্চিমা দুনিয়াজুড়ে শুরু হয়েছে হৈচৈ-তোলপাড়। পত্রপত্রিকা-টেলিভিশনসহ বিশ্বমিডিয়ায় অতিশয়োক্তির বান ডেকেছে। শিরোনামের অতি-বাড়াবাড়ি দেখে আপনার মনে হবে খাদ্য নিয়ে যেনবা শুরু হয়ে গেছে কেয়ামত; ‘হট ডগ আপনার জন্য সিগারেটের মতো সমান ক্ষতিকর’(‘HOT DOGS AS BAD YOU AS CIGARETTES’)—এমন শিরোনামও হচ্ছে আজকাল। এর ফলে খাদ্যসচেতন যারা তারা হচ্ছেন বিভ্রান্তির শিকার; এসব মানুষ সঠিক স্বাস্থ্যকর খাবারটা বেছে নিতে গিয়ে দো-টানায় পড়ছেন। কারণ তাদের জন্য আজ বিভিন্ন রকমের যেসব পরামর্শ বাতলানো হচ্ছে বছরকয় পরে সেগুলোর ব্যাপারে বলা হচ্ছে উল্টো কথা। খাদ্য নিয়ে এ-এক লেজেগোবরে অবস্থা।

যে যাই বলুক আমেরিকানরা দুনিয়ার সবচেয়ে মাংসভোজী জাতি। মাংসজাত খাবার না হলে আমেরিকানদের একদিনও চলে না। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, আমেরিকানরা ওই বছর গড়ে ৭১ পাউন্ড গরুর মাংস (বিফ), বাছুরের মাংস ও ভেড়ার মাংস ভক্ষণ করেছে। আর ২০১৪ সালে সব আমেরিকান মিলে শুধু গরুর মাংসই খেয়েছে ২০৪১ কোটি পাউন্ড। আর উৎপাদিত মাংসের যেটুকু উদ্বৃত্ত থাকে বা নিজেরা খেয়ে সাবাড় করতে পারেনি সেটা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে করে রপ্তানি। মাংসের চাহিদার সাথে আমেরিকার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির দিকটাও জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র শূকরের মাংসের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। আর গরুর মাংস রপ্তানিতে বিশ্বে চতুর্থ। যেমনটা আগে বলেছিলাম, হলিউড মুভি ও গানের পাশাপাশি আমেরিকার উৎপাদিত মাংসও সারা দুনিয়ার বাজার দখল করে আছে।

কিন্তু সে যা-ই হোক। এসব নিয়ে, বিশেষত আমেরিকানদের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। টাইম ম্যাগাজিনও তেমনটাই মনে করে। সাময়িকীটি মাংস ও ক্যান্সারের মধ্যকার যোগসূত্রের কথাটিই সামনে এনেছে ৯ নভেম্বরের সংস্করণের কভার স্টোরিতে। এটির শিরোনাম তারা দিয়েছে: ‘দ্য ওয়ার অন ডেলিশাস’ (THE WAR ON DELICIOUS’) । যদিও মাংসের সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্ক রয়েছে বলে যে ধারণা, সে ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের কাছে পুরোপুরি নতুন কিছু নয়। এ সংক্রান্ত ধারণার পক্ষে নিত্য নতুন প্রমাণও মিলছে আজকাল।

কয়েক দশক ধরেই হেলথ এক্সপার্টরা মানুষকে হুশিয়ার করে আসছেন, হৃদরোগ, স্থূলতা এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের সঙ্গে রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসপ্রধান খাবারের একটা যোগসূত্র রয়েছে। প্রথম দুটি বিপদ অর্থাৎ হৃদরোগ ও স্থূলতা বিষয়টি নিয়ে লোকজনের মধ্যে এক ধরনের সতর্কতারও জন্ম হয়েছে। লোকজন বেশ সচেতন আজকাল। এ কারণে অনেকেই এখন তাদের খাদ্য তালিকা থেকে মাংসের পরিমাণ কমিয়েছেন বা মাংস বাদ দিয়েছেন। কিন্তু তিন মারণব্যাধির সর্বশেষটি অর্থা ক্যান্সারের ব্যাপারটা নিয়ে চলছে রাখঢাক গুরগুর্‌।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বার্গার, হট ডগ এসব খাবার ছাড়া চলবে কি আমেরিকানদের? প্রশ্নের জবাবটা শুধু বিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। এজন্য বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে। এর ফয়সালা করার আগে ব্যাপক বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। এই ব্যাপারে যারা স্টেইক হোল্ডার তাদের মধ্যে পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট থেকে শুরু করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবাদী, মাংস উৎপাদক কৃষক, কৃষি-ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত তাবড় তাবড় এগ্রিকালচারাল প্রতিষ্ঠান এবং মাংসের যারা ভোক্তা তারা সবাই আছেন।

চলবে ...

বাংলাদেশ সময়: ০৮০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০১৫
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।