ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--২

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৫
সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--২

[[ মাংসপ্রীতির ব্যাপারটি আছে মানুষের রক্তে আর জিনে। অল্প সংখ্যক সবজিভোজীর বাইরে মাংসপ্রীতি কমবেশি আমাদের সবার মধ্যেই আছে।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে নানান গবেষণায় বলা হচ্ছে, মাংসপ্রীতি ভালো নয় মোটে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা সম্প্রতি ব্যাপকভিত্তিক এক গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছে ক্যান্সারসহ নানা রোগের জন্য রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। আর এসব মাংসের সবচেয়ে বড় ভোক্তা আমেরিকানরা। এ নিয়ে টাইম ম্যাগাজিন তাদের চলতি সংখ্যায় ‘‘THE WAR ON DELICIOUS’’ শিরোনামে কভার স্টোরি করেছে। এরই সূত্র ধরে কনসালট্যান্ট এডিটর জুয়েল মাজহার লিখেছেন তিন পর্বের এই লেখাটি। পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি]]


মাংসের রকমফের বা ক্যাটাগরি:
মাংসের ক্যাটাগরিটা ব্যাপকভিত্তিক। গবেষণায় সব ধরনের মাংসকেই রাখা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কোন কোন মাংসকে আমরা রেড মিট বলবো? বিজ্ঞানীরা এর একটা সংজ্ঞাও ঠিক করেছেন। তাদের মতে, স্তন্যপায়ী পশুদের সব পেশীর মাংসই রেডমিট। আরো খোলাসা করে বললে, গরুর মাংস, বাছুরের মাংস, ভেড়ার মাংস, খাসি বা ছাগলের মাংস, শূকর ও ঘোড়ার মাংসকেই রেড মিটের আওতায় পড়ে। এই কিছুদিন আগেও শূকরের মাংসকে ‘হোয়াইট মিট’ বা ‘নির্দোষ মাংস’ হিসেবে গণ্য করা হতো। এবার আর এটিকে নির্দোষ মাংসের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আর প্রসেসজড মাংস বা প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস আমরা কোন মাংসকে বলবো সে প্রসঙ্গে আসা যাক। যে মাংস সংরক্ষণ করার জন্য লবণ মেশানো হয়েছে, ফার্মেন্টেড করা হয়েছে, মসলা বা মুখরোচক উপাদান মেশানো হয়েছে, ধোঁয়া বা আগুনের তাপ দেওয়া হয়েছে, সে মাংসই প্রসেসজড মিট বা প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার নতুন গাইড লাইন আমেরিকানদের প্রিয় খাবার মানলে টার্কি বেকনও কিন্তু পড়বে এই ক্যাটাগরিতে।

ডব্লুএইচও-র গবেষণা ও অশনি সংকেত
মাংস ও ক্যান্সারের যোগসূত্র নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার পক্ষ থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাটি করেছে ডব্লুএইচও (WHO)-র  সহযোগী সংস্থা আইএআরসি (IARC)। ইংরেজিতে এর পুরো নাম ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার। তারা প্রক্রিয়াজাত নয় এমন হাস-মুরগি বা পোল্ট্রির মাংসকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রেখেছেন। পোল্ট্রির মাংস নিয়ে পাবলিক হেলথ এক্সপার্টদের মনে কোনো উদ্বেগ আগেও ছিল না , এখনও নেই। কিন্তু নতুন গবেষণায় পোল্ট্রির মাংসসহ সব ধরনের মাংসকেই রাখা হয়েছে সন্দেহের তালিকায়। কেননা পোল্ট্রির মাংসের একটা বড় অংশই প্রক্রিয়াজাতকৃত। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়, ক্যান্সারের আক্রান্ত ৩৪ হাজার মানুষের মারা যাওয়ার জন্য দায়ী করা হয়েছে প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসকে। আর ৫০ হাজার ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছে রেড মিটকে। যদিও তামাক বা ধূমপানজনিত ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর পরিসংখ্যানটা আরো বড়---১০ লাখ। আমেরিকাতে কলোরেক্টাল ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পেছনে প্রকারান্তরে মাংস ভক্ষণকে অংশত দায়ী করা হয়। মাংস খাওয়ার কারণে মৃত্যু না হলেও তা মানুষকে অসুস্থ করে তোলে বা মানবশরীরে নানা রোগের জন্ম দেয়। গবেষকরা এদিকটায় জোর দিচ্ছেন এখন।

ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যান্সার এপিডেমোলজিস্ট ডাক্তার ম্যারিয়ানা স্টার্নের মতে, কলোরেক্টাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী যেসব কারণ রয়েছে এই নতুন গবেষণার কারণে আমরা মূল্যবান একটা ধারণা অন্তত পাচ্ছি। জানা থাকলে কিছু একটা করার উপায়ও থাকে। লাভ এখানেই।

 কিন্তু বিশ্ব খাদ্যসংস্থার এই গবেষণার কারণে মাংস-শিল্পের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো বড়ই নাখোশ। একে তারা তাদের ব্যবসার পথের কাঁটা হিসেবে দেখছেন। নর্থ আমেরিকান মিট ইনস্টিটিউট (NAMI)  বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার গবেষণার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, রিপোর্টটিতে নাকি কাণ্ডজ্ঞানের বালাই নেই। তাদের দাবি, মাংস ভোজনের সঙ্গে ক্যান্সারের কোনো সম্পর্কই নাকি নেই। কোনো একটা বিশেষ খাবার বা খাদ্য উপাদানকে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের জন্য দায়ী করার কোনো ভেজ্ঞানিক ভিত্তি নাকি নেই। বলা বাহুল্য, NAMI নামের প্রতিষ্ঠানটি খুবই প্রভাবশালী। যুক্তরাষ্ট্রে ৯০ শতাংশ রেড মিট  এবং ৭০ শতাংশ টার্কির মাংস প্রক্রিয়াজাত করে যেসব বাঘা বাঘা কোম্পানি, NAMI তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এদের সদর দপ্তর রাজধানী ওয়াশিংটনে।

কিন্তু এসব মুনাফাখোর কোম্পানি যতো যা-ই বলুক আইএআরসি-র রিপোর্টটা কিন্তু খুবই মানসম্পন্ন এক নিবিড় গবেষণার ফল। এটা একক কোনো গবেষণা নয়, বরং বহু গবেষণার মিলিত ফল এই রিপোর্ট। ১০ টি দেশের ২০ জন গবেষক মিলে করেছেন এই গবেষণা।

প্রতিদিন হট ডগ খেলেন তো ক্যান্সারকে ডেকে আনলেন!
তারা তাদের গবেষণায় দাবি করেছেন, প্রতিদিন কেউ যদি ৫০ গ্রাম প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস (একটা হট ডগ বা ৬ টুকরা বেকন) খান, তাহলে তার কলোরেক্টাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্তত ১৮ শতাংশ বেড়ে যাবে।  

স্টম্যাক ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার এবং প্যানক্রিয়াটিকের ক্যান্সারসহ আরো যেসব ক্যান্সার রয়েছে সেগুলোও রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে সবচেয়ে বেশি লোকের মৃত্যু হয়কলো-রেক্টাল ক্যান্সারে। ডা. ম্যারিয়ানা স্টার্নের দাবি: ‘এ ব্যাপারে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে, প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস খেলে কলো-রেক্টাল ক্যান্সার হয়। ...আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, রেড মিট শরীরে ক্যান্সার হওয়ার জন্য সম্ভাব্য দায়ী। ’ 

মাংস খাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতাবার্তা:
২০০৭ সালে পরিচালিত এক ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা  চালিয়েছিল আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর ক্যান্সার রিসার্চ (এআইসিআর) ও ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার রিসার্চ ফান্ড (ওসিআরএফ) । গবেষণায় দেখানো হয়েছে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সারের সঙ্গে পশুর মাংসজাত প্রোটিনের সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH) এক গবেষণা চালায়। তাতে বলা হয়েছে, রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংস না-খাওয়াদের চেয়ে যারা এসব খান তাদের ক্যান্সার, হৃদরোগ ও অন্যান্য কারণে মারা যাওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।

২০১১ সালে ওয়াল্ড ক্যান্সার রিসার্চ ফান্ড পরিচালিত আরেক গবেষণায় কলো-রেক্টাল ক্যান্সারের সঙ্গে রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের মধ্যে যোগসূত্র পাওয়া যায়। এরপর ২০১৩ সালে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ৪৭ জন গবেষকের একযোগে পরিচালিত বড় ধরনের এক গবেষণায়ও উঠে আসে অনুরূপ বক্তব্য। আইএআরসি-পরিচালিত এই গবেষণাটিই এক্ষেত্রে এযাবৎকালে পরিচালিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় গবেষণা। ক্যান্সারের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির পাশাপাশি হৃদরোগজনিত কারণে ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহারের সঙ্গে রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।

মাংস নিয়ে এতোসব খারাপ খবরের পাশে আমরা এসত্যটা ভুলে যেতে পারি না যে, পশুর মাংসল পেশি প্রোটিন আর নানাবিধ পুষ্টিকর উপাদানে ভরপুর থাকে। দেশে কোনো কারণে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব দেখা দিলে পেশির মাংসই পশুর দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও পুষ্টির যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে। গরু বা শূকরের চর্বিতেও ক্যালরির প্রচুর যোগান মজুদ থাকে। আর পশুর মাংসের ঘ্রাণও আমাদের স্নায়ুকে উদ্দীপিত করে আর আমাদের মধ্যে খাওয়ার আগ্রহকে উস্কে দেয়। পোড়া মাংসের ঘ্রাণ নাকে আসা থেকেই বিপত্তির শুরু। খুব বেশি তাপে মাংস রান্না করা হলে তা থেকে দুটো ক্ষতিকর উপাদান সৃষ্টি হয়। একটি হচ্ছে পরিসাইক্লিক অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন (HCAs) আর অন্যটা হেটেরোসাইক্লিক অ্যামাইন্‌স। এ-দুয়ে মিলে শরীরের ডিএনএ( DNA)-কেই দেয় বদলে। আর সেটা যখন হয় তখন তাকে শরীরের জন্য এক অশনিসংকেত হিসেবেই গণ্য করতে হবে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিভেনশন রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ডা. ডেভিড কাট্‌জ—এর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো একটা বড় দু:সংবাদ: ‘ডিএনএ’-র কোনোরূপ ক্ষতি হওয়া মানে ক্যান্সারের সূচনা হওয়া। ’ এমনটা হলে বাঁচার আপাতত একটা রাস্তাই খোলা---দেহের ক্যান্সারদুষ্ট কোষকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা। ক্যান্সারটা প্রথম দেখা দেয় একদল দুর্বৃত্ত কোষের রূপে; পরে এরা বড়সড় টিউমারের রূপ নেয়। (চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৫
জেএম/

** সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।