[[ মাংসপ্রীতির ব্যাপারটি আছে মানুষের রক্তে আর জিনে। অল্প সংখ্যক সবজিভোজীর বাইরে মাংসপ্রীতি কমবেশি আমাদের সবার মধ্যেই আছে।
প্রক্রিয়াজাত মাংসে ক্ষতিকর নানা উপাদান:
প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের বেলায় সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা আসে সোইডয়াম নাইট্রেটস থেকে। এই ভয়ঙ্কর উপাদানটি প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসে ব্যবহার করা হয় মূলত পচনরোধী প্রিজারভেটিভ হিসেবে। প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের মধ্য দিয়ে এগুলো আমাদের শরীরে প্রবেশ করার পর এরা দেহে নাইট্রোসেমাইনস্ নামের এক ধরনের রাসায়নিক তৈরি করে। আর সেটা শরীরের ক্যান্সারের জন্ম দেয়। শুধু প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসই নয়, এমনকি প্রক্রিয়াজাত নয় এমন রেড মিটও একই রকম সমস্যার জন্ম দিতে পারে। ক্ষুদ্র অন্ত্র ও বৃহৎ অন্ত্রে থাকে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া মাংসের নির্দোষ উপাদানগুলোকেও নাইট্রোসেমাইনে পরিণত করে ফেলে। গ্রিল করা মাংস যথেষ্ট পোড়া-পোড়া হলে তা থেকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান বা কারসিনোজেনের সৃষ্টি হতে পারে।
আর ‘নো নাইট্রেটস এডেড’ (বা ‘মেশানো হয়নি কোনো নাইট্রেটস’) লেখা থাকে যে প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের প্যাকেটের গায়ে, সেটিকে কি নিরাপদ ভাবছেন? নাইট্রেট-এর বদলে কিন্তু এই মাংসে মেশানো হয় সেলারি জুস নামের একটা উপাদান। সেটাতেও কিন্তু উচ্চমাত্রার সোডিয়াম নাইট্রেট থাকে। এর মানে হলো কারসিনোজেন থেকে আপনি তবুও নিরাপদ নন।
রেড মিট মিক্সে থাকে ‘হেম আয়রন’ নামের একটা রাসায়নিক । গাছপালা ও উদ্ভিদে থাকে কেবল ‘ননহেম আয়রন’। কিন্তু সব মাংসেই ‘হেম আয়রন’ ও ‘নন হেম আয়রন’ দুটোই থাকে। পশ্চিমা দুনিয়ার খাবারে যে আয়রন থাকে তার ১০ থেকে ১৫ শতাংশই হচ্ছে হেম আয়রন। এই হেম আয়রন শরীরে বেশিদিন উপস্থিত থাকলে এক সময় তা কোলনে গিয়ে বাসা বাঁধবেই। আর তখন বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার শিকার হয় শরীর। বৃহদান্তের কোষে এর সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়ে।
মাংসপ্রেমীদের জন্য খারাপ সময়:
যারা মাংস খেতে ভালোবাসেন তাদের জন্য যেমন , তেমনি যারা মাংস বিক্রি করেন ---দু’পক্ষের জন্যই এটা এক খারাপ সময়। আমেরিকার বাজারে চলছে এখন খাবার নিয়ে নানান কাণ্ড যা ক্ষ্যাপামির পর্যায়ে চলে গেছে। সেই সঙ্গে চলছে বিশেষ বিশেষ খাবার গ্রহণের মৌসুমি বাতিক। এসবের মধ্যে আছে অতিমাত্রায় বেকনপ্রিয়তা। সবকিছুই যেন বেকনে বেকনে সয়লাব। বেকন বিয়ার, বেকন ভদকা, বেকন মিল্কশেক, বেকন পপকর্ন থেকে শুরু করে মায় বেকন কনডমেরও বাজার এখন রমরমা। এই কনডমের ঘ্রাণটা অবিকল বেকনের ঘ্রাণের মতো।
পাশাপাশি গরুর মাংসের চাহিদাও এখন বাজারে তুঙ্গে। নইলে কি আর বিফ স্টেকের রেস্তোরাঁগুলো গত বছর ৭০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে!৭০—এর দশকে অবশ্য প্রত্যেক আমেরিকান বছরে এখনকার (৭১ পাউন্ড) চেয়েও বেশি পরিমাণ (৯৬ দশমিক ৩ পাউন্ড ) খেতেন। এখন রেড মিট ছেড়ে অনেকে ঝুকেঁছেন পোল্ট্রির মাংসের দিকে। রেড মিট খাবার প্রবণতা কমছে বলে ক্যান্সারে মৃত্যুর হারও আগের চেয়ে কমেছে। এ সত্ত্বেও আশঙ্কা করা হচ্ছে চলতি বছর আরো ৯৬ হাজার ৯০ জন কোলন ক্যান্সারে এবং ৩৯ হাজার ৬১০ জন রেক্টাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন। এমনতি গড়পড়তা আমেরিকানদের মধ্যে কলোরেক্টাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি ছেলেদের বেলায় ৫ শতাংশ আর মেয়েদের কিছুটা কম। কিন্তু যারা রেড দিনে একটা হট ডগ খান , তাদের বেলায় ঝুঁকিটা অনেক বেড়ে যায়।
...আমেরিকার স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের পথে বড় বাধা পুঁজির দাপট:
এতো কিছুর পরও, মাংসের (রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত) ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে এতো-এতো গবেষণার পরও আমেরিকার স্বাস্থ্যনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তনের আশা নেই খুব একটা। এর পেছনে আছে বড় পুঁজির প্রভাব। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের ওপর মাংস উৎপাদক খাত মানে এগ্রো-বিজনেসের প্রভাব অনেক প্রবল। কেবল এখাত থেকেই ২০১৩ সালে আমেরিকান জিডিপিতে যোগ হয়েছে প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার। গত বছর এই খাত সরকারের এবং আইনসভার লোকদের পেছনে লবি করার জন্যই ব্যয় করেছে ২৭ মিলিয়ন ডলার। এই তথ্যটা জানাচ্ছে সেন্টার ফর রেসপনসিভ পলিটিক্স নামের একটা পর্যবেক্ষক সংস্থা। প্রায় ১০০০ লবিস্ট আছে ওদের। এছাড়া এদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক গ্রুপ আছে এরাও লবিস্টদের পেছনে ৭৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। যার সিংহভাগই গেছে লোভী রিপাবলিকানদের পকেটে।
আইএআরসির গবেষণা যতো জোরালোই হোক, অপ-মাংসের কারণে আমেরিকান জাতির স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর ক্যান্সারসহ নানা মারণব্যাধির ঝুঁকি যতোই বাড়ুক এফডিএ(ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)-এর টনক নড়বে বলে মনে হয় না। এফডিএ-র এনিয়ে এক প্রশ্নবিদ্ধ গবেষণা করেছে যাতে রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসের সঙ্গে সৃষ্টিকারী কারসিনোজেনের সম্পর্ক নাকি খুঁজে পাওয়া যায় নি। নিন্দুকেরা বলছেন, সবই বড় পুঁজির খেলা। আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়ে ডলারলোভী লবিস্টের দল।
তবে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার কিছুটা ব্যতিক্রম। তারা চলতি বছরের ডায়েটারি গাইডলাইন প্রকাশ করতে চলেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশায় আছেন, ওতে অন্তত রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাত মাংসের ব্যাপারে মক্ত অবস্থান তুলে ধরা হবে। আইএআরসি-র রিপোর্টটাকে তারা আমলে নেবেন বলেই সবাই আশা করে আছেন।
তবু সহজে যাবে কি আমেরিকানদের মাংসপ্রীতি?
এতো যে সতর্কবাণী তার পরও কি সহজে দূর হবে এই মাংসপ্রীতি?---এই প্রশ্নটাই এখন আমেরিকানদের সামনে। কেউ কেউ বলছেন, এখন না হলেও ধীরে ধীরে হলেও টনক নড়বে আমেরিকানদের। কিন্তু মাংসপ্রীতি এমন এক ব্যাপার যা আছে মানুষের জিনের ভেতর। এমনকি পাঁড় সবজিভোজী যারা তাদের মনের ভেতরেও নাকি জেনেটিক কারণে মাংসপ্রীতিটা ঘুমিয়ে থাকে। মানে তাদেরও মনে লুকিয়ে থাকে মাংস খাওয়ার লোভ। তারা কঠোর সংযম দিয়ে সেই নাছোড় লোভটাকে দমিয়ে রাখেন কেবল। হোমো সেপিয়ানদের বড় কৃতিত্ব যে তারা মাংস ও সবজি দুটোতেই নিজেদের অভ্যস্থ করতে পেরেছে। যা ইতিবাচক লক্ষণ। আর প্রত্যেক জাতিরই আছে নিজের নিজের আলাদা খাদ্যাভ্যাস। যে আমেরিকানদেরও আছে। তবে কিনা অন্যদের চেয়ে আমেরিকানদের মাংসপ্রীতিটা অনেক বেশি। বিপদটাও সেখানেই। অন্যসব জাতির লোকদের চেয়ে এ কারণে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং স্থূলতাসহ নানান রোগের ঝুঁকি আমেরিকানদের বেলায় ঢের ঢের বেশি। এসব ঝুঁকি থেকে মুক্ত হতে চাইলে তাদেরকে একটা কাজই করতে হবে। আর তা হচ্ছে নিজেদের খাদ্যাভ্যাসটা ধীরে ধীরে বদলে ফেলা। মানে রেড মিট, পক্রিয়াজাতকৃত মাংস বা বার্গার, হট ডগ, সসেজ, বেকন, ইত্যাদির মজ্জাগত নেশা থেকে সরে আসতে হবে। কিন্তু আমেরিকানরা কি তা পারবে? কেননা তাদের ‘কালচারাল ডিএনএ-র ভেতরেই যে রয়ে গেছে মাংসপ্রীতি। মাংসভক্ষণ ঐতিহ্যের দীর্ঘ লিগ্যাসি নাকি সুস্বাস্থ্যের হাতছানি---কোনটাকে ফেলে কোনটা নিয়ে এগোবে তারা, সে জবাব সময়ই দেবে। আপাতত আসুন আমরা নিজেদের দিকে তাকাই; চলুন যতোটা সম্ভব ক্ষতিকর রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাত মাংসের লোভকে দমন করে চলি। নিজের স্বাস্থ্যের দেখভাল ও সুরক্ষা তো নিজেদেরকেই করতে হবে, নাকি না?
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫
জেএম
** সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--১
** সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--২
স্বাস্থ্য
সাবধান! জলদি ছাড়ুন মাংসপ্রীতি--৩
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।