ঢাকা: হিমোফিলিয়া মরণব্যাধি রোগ হলেও দেশে এর উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ঢাকায় নামমাত্র চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও ঢাকার বাইরে নেই।
দেশের বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে প্লাজমা তৈরির মেশিন থাকলেও তৈরি হয় না প্লাজমা। নেই এ রোগ নির্ণয়ের মেশিন, জনবল ও চিকিৎসক।
ক্রমেই বাড়ছে এ রোগীর সংখ্যা। কিন্তু রোগ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা না থাকায় দেশে কি পরিমাণ রোগী রয়েছেন, প্রতি বছর কতোজন নতুন করে যোগ হচ্ছেন, নেই তার সঠিক পরিসংখ্যান।
এ রোগীর চিকিৎসায় একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল, আক্রান্ত রোগীদের পুনর্বাসন, জেলা-উপজেলা হাসপাতালে এ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি সূত্রে জানা গেছে, হিমোফিলিয়া রক্তক্ষরণজনিত ও বংশানুক্রমিক রোগ। এ রোগ পুরুষের হলেও বাহক নারী। আক্রান্তদের রক্ত জমাট বাঁধে না। ছোট-খাটো আঘাত বা কেটে গিয়ে রক্তক্ষরণে মৃত্যু হতে পারে। মানুষের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার জন্য অণুচক্রিকা ছাড়াও ১৩টি ফ্যাক্টর থাকে। এর মধ্যে ফ্যাক্টর-৮ ও ৯ অনুপস্থিত থাকলে এ রোগ হয়। এ রোগের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিও এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তবে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, ক্রাইয়োপ্রিসিপিটেট (রক্ত থেকে তৈরি উপাদান) বা কগোলেশন ফ্যাক্টর নামে দুই ধরনের ইনজেকশনের মাধ্যমে এর চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, এ রোগ নির্ণয়ে দেশের কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেশিন নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘সেফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন’ প্রকল্পের অধীনে ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাজমা তৈরির মেশিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাজমা তৈরি হয়। আটটিতে নেই পর্যাপ্ত জনবল। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে এ রোগীদের চিকিৎসায় আইএসটিসি ক্লিনিক চালু রয়েছে।
সূত্র জানায়, এ রোগের চিকিৎসায় দেশে মাত্র ৬০ জন চিকিৎসক (রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ বা হেমাটোলজিস্ট) থাকলেও ৫০ জনই থাকেন ঢাকায়। বদলি করা হলেও ঢাকার বাইরে তারা থাকতে চান না।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব হিমোফিলিয়ার তথ্য মতে, বাংলাদেশে এ রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ৬৪০ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটির সদস্য রয়েছেন ৭৫০ জন। প্রতি লাখে ২০ জন এ রোগে আক্রান্ত। প্রতি ৩ জন রোগীর মধ্যে একজন বংশানুক্রমে না হয়ে নতুনভাবে আক্রান্ত হন। তবে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা না থাকায় নেই সঠিক পরিসংখ্যান।
নাসিম মোস্তাফিজ জন্মের পর থেকে এ রোগে আক্রান্ত। তিনি বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। বংশানুক্রমে না হলেও তিনি ফ্যাক্টর-৯ এ আক্রান্ত।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমার দেড় বছর বয়সে এ রোগ শনাক্ত হয়। প্লাজমা, ইনজেকশন নিয়ে ৩৯ বছর বেঁচে আছি। প্রতিটি ইনজেকশনের দাম ফ্যাক্টর অনুযায়ী ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, মরণব্যাধি এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হলেও সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই।
তিনি বলেন, রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকায় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার কিছুটা ব্যবস্থা থাকলেও ঢাকার বাইরে নেই। রোগী শনাক্ত করা ও চিকিৎসায় সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেশিন ও চিকিৎসক দিতে হবে।
এ রোগীদের চিকিৎসায় একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা কেন্দ্র চালু, জনবল, চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া ছাড়া কোনোভাবেই এ মৃত্যু রোধ সম্ভব নয় বলেও মনে করেন নুরুল ইসলাম।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক সালমা আফরোজ বাংলানিউজকে বলেন, ফ্যাক্টর ইনজেকশন ব্যয়বহুল। ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমাই আমাদের একমাত্র ভরসা।
তিনি বলেন, দেশে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন যে পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করা হয় তা থেকে পর্যাপ্ত প্লাজমা তৈরি ও চিকিৎসা করা সম্ভব।
মেশিন আছে, রক্তও সংগ্রহ হয়, প্লাজমা তৈরি হয় না কেন? শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই নয় নয় সারাদেশের মেডিকেল কলেজ, জেলা-উপজেলা হাসপাতালে মেশিন, চিকিৎসক দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
৮টি বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিগগিরই প্লাজমা তৈরির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হক।
ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নেই, তবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ মেশিন দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মেশিন-চিকিৎসক দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এইচএমআইআর (হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) মাধ্যমে এ রোগীর সংখ্যা ও তথ্য নেওয়া হবে। পরিসংখ্যান জানা গেলে চিকিৎসা সহজ হবে।
ঢাকার বাইরে এ রোগের চিকিৎসা নেই স্বীকার করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ রোগের রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
এ রোগ নির্ণয় ও প্লাজমা তৈরি মেশিন, চিকিৎসক, জনবল দেওয়াসহ সকল ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন মোহাম্মদ নাসিম।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
আরইউ/এএসআর