ঢাকা: পরিবার পরিকল্পনায় স্বল্পমেয়াদী পদ্ধতিগুলো জনপ্রিয়তা পেলেও সক্ষম দম্পতিদের আস্থা কুড়াতে ব্যর্থ হয়েছে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিগুলো। সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টাও দম্পতিদের এদিকে আকৃষ্ট করতে পারছে না।
নারীরা পরিবারের স্বার্থে এসব পদ্ধতি নিতে রাজি হলেও পুরুষরা এক্ষেত্রে স্বার্থপরতা দেখান। তারা নিজের শরীরে কোনো পদ্ধতি নিতে একদমই নারাজ।
এসব তথ্য দিচ্ছেন মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বিশেষ করে, টিউবেকটমি ও আইইউডি’র প্রতি দম্পতিদের আতঙ্ক কাটাতে সব চেষ্টাই অসফল প্রমাণিত হয়েছে। পুরুষরা ‘ভ্যাসেকটমি’ শব্দটি শুনতেও চান না। ইমপ্লান্ট নিয়ে রয়েছে অনাগ্রহ। তারা এ পদ্ধতি নিতেই চান না, নিলেও ক’দিন পর এসে রাগারাগি করেন, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সম্মিলিত উদ্যোগ চালিয়েও খুশির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সক্ষম দম্পতিদের ক্ষেত্রে দু’সন্তানের মাঝে ন্যূনতম (৩ বছর) বিরতি এবং ২টি জীবিত সন্তানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির বয়স কমপক্ষে ১ বছর হলে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে চায় সরকার।
স্বাস্থ্য সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. নূর হোসেন তালুকদার বলছেন, এসব পদ্ধতিতে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু এখনো দম্পতিদের সেভাবে আগ্রহ বাড়ানো যাচ্ছে না।
মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারে সরেজমিনে মেলে আক্ষেপের সত্যতা।
মিরপুর থেকে এসেছেন সুলতানা-বরকত দম্পতি। কিছুতেই স্থায়ী পদ্ধতি নেবেন না বলে কড়া গলায় জানান বরকত। দু’টি সন্তান থাকলেও কখন পরিস্থিতি কেমন হয়- সেই আশঙ্কায় নিজেদের ‘খুঁত’ করাবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।
বাচ্চাতো আমার পেটে নেব না। সুলতানা (স্ত্রী) পদ্ধতি নিতে চাইলে, সেটা তার বিষয়। আমি এসবে নাই, বললেন বরকত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, দম্পতিরা স্থায়ী পদ্ধতির কথা শুনলে এভাবেই রিঅ্যাক্ট করেন, আঁৎকে ওঠেন। দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতির প্রতিও তাদের খুব অনাস্থা। বড় কোনো ক্ষতি হতে পারে- এমন সন্দেহে নিতে চান না। ভ্যাসেকটমি ও টিউবেকটমি করানোকে তারা বন্ধ্যাত্ববরণ বলে মনে করেন। কারও কারও কাছে এসব ঘোরতর পাপ।
বিশেষ করে, সক্ষমরা এসব পদ্ধতি নিতেই চান না। যাদের রাজি করানো যায়, তাদের বেশিরভাগই ইতিমধ্যে কয়েক সন্তানের জনক বা জননী, বলেন তিনি।
এক কর্মচারী জানান, বোঝাতে গেলে কেউ কেউ তেড়ে আসেন। মনে করেন, তাদের বন্ধ্যা বানিয়ে আমরা টাকা কামাবো। খুবই মুশকিল হয়। একজন লোক নিজেই আগ্রহ করে এসেছিলেন ভ্যাসেকটমি করাতে। পরে জানা গেল, তিনি লুঙ্গি ও টাকা পাওয়া যাবে শুনে এটি করাতে এসেছেন। কারণ তার নেশার অভ্যাস রয়েছে।
বাংলাদেশ জনমিতিক ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস)-২০১৪’র তথ্যমতে, গত ১০ বছরে (২০০৪-২০১৪) জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৫৮ দশমিক এক শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ দশমিক চার শতাংশ হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতির প্রতি প্রবল অনাগ্রহ থাকায় এক্ষেত্রে অগ্রগতি পাননি সংশ্লিষ্টরা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের হার বাড়াতে সক্ষম দম্পতিদের বিভিন্ন তথ্য ও সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিডিএইচএস-২০১৪’র তথ্য আরও বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩১ লাখ প্রসব হয়, যার প্রায় ১১ লাখ প্রসব হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। সংশ্লিষ্টরা এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চান। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের পরপরই মাকে উপযুক্ত পদ্ধতির আওতায় আনলে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ এড়ানো যাবে, বলছেন কর্মকর্তারা।
অধিদপ্তরের এমআইএস ইউনিট (২০১৪)’র প্রতিবেদন বলছে, সক্ষম দম্পতিদের তথ্য ও নিবিড় সেবা দিয়ে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহীতার হার বাড়াতে সেবা সপ্তাহ ভূমিকা রাখে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে সেবা সপ্তাহে পদ্ধতি গ্রহীতার সংখ্যা বাড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ।
গত ৭ নভেম্বর থেকে ‘পরিবার পরিকল্পনা, মা-শিশু-কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও প্রচার সপ্তাহ’ পালিত হয়। এবার থিম রাখা হয়েছিল ‘প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করুন, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ রোধ করুন। ’
সপ্তাহটিতে দম্পতিদের বোঝানো হয়েছে, প্রসবের পর প্রথম ১২ মাসের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত ও স্বল্প বিরতিতে আবারও গর্ভধারণ যাতে না হয়, সে ব্যবস্থাটিকে প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা বলে। এর কৌশলগত দিক হিসেবে বলা হয়েছে- প্রসবের পর উপযুক্ত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিটি নেওয়া বা দু’টি সন্তান জন্মদানের মধ্যবর্তী সময়ে নারীর ইচ্ছানুযায়ী প্রয়োজনীয় বিরতি (কমপক্ষে ৩ বছর), অথবা সন্তান জন্মদান সীমিত করা।
এভাবেই জাতীয় জনসংখ্যা নীতি-২০১২, এইচপিএনএসডিপি’র লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, সিপিআর ৭২ শতাংশে উন্নীত এবং টিএফআর ২ দশমিক এক শতাংশ অর্জনের পথ সহজ করতে চান সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৫
এসকেএস/আরএম