ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

উদ্ভিজ্জ অ্যান্থোসায়ানিন

একটি নিরাপদ ও শক্তিশালী প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট

ড. মো. আব্দুর রহিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৬
একটি নিরাপদ ও শক্তিশালী প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট

শাক-সবজি ও ফলমূল মানুষের খাদ্যের অন্যতম মৌলিক উপাদান। এগুলো মানবদেহের অপরিহার্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের অন্যতম যোগানদাতা।

এছাড়াও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটসের অন্যতম প্রধান উৎস।   রঙিন শাক-সবজি, ফলমূল ও ফুলে উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন ও স্বাস্থ্য সহায়ক উদ্ভিদ রঞ্জক (প্ল্যান্ট পিগমেন্ট) থাকায় এগুলোর প্রতি মানুষের চাহিদা ও সচেতনতা দিন দিন বেড়ে চলছে।

ক্লোরোফিল ছাড়া অন্য প্রধান উদ্ভিজ্জ রঞ্জকগুলো হলো- ক্যারোটিনয়েড, ফ্লাভোনয়েড ও বেটালিন। ফ্লাভোনয়েড হচ্ছে উদ্ভিজ্জ সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ গ্রুপ। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার প্রকার ফ্লাভোনয়েড শনাক্ত করেছেন। আর অ্যান্থোসায়ানিন হলো ‘ফ্লাভোনয়েড’ গ্রুপের এক ধরনের উদ্ভিজ্জ বায়োঅ্যাক্টিভ যৌগ বা উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল ও মূলের বর্ণের প্রধান নিয়ামক।

অ্যান্থোসায়ানিন সাধারণত কোষের সাইটোপ্লাজমে তৈরি হয়। এটি পানিতে দ্রবণীয় এবং কোষ গহ্বরে গিয়ে সঞ্চিত হয়। এটি উদ্ভিদের বিভিন্ন বর্ণ যেমন- কমলা, লাল, গোলাপি ও নীল বর্ণের জন্য দায়ী। উদ্ভিদে এদের এই বর্ণ বিভিন্নতার কারণ হলো কোষে উপস্থিত বিভিন্ন ধরনের সহ-রঞ্জক, মেটাল আয়ন ও কোষ গহ্বরের পিএইচ। দৃশ্যমান উদ্ভিজ্জ রঞ্জকগুলোর মধ্যে ক্লোরোফিলের পরেই অ্যান্থোসায়ানিনের অবস্থান।

অ্যান্থোসায়ানিন উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফলকে বর্ণিল করে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ও প্রাণীকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে পরাগায়ণ ও প্রাকৃতিকভাবে বীজ বিস্তারে সাহায্য করে। এছাড়াও এরা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উদ্ভিদকে রক্ষা করে। ১৮৩৫ সালে জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী লুডউইং মার্কাট অ্যান্থোসায়ানিনের নামকরণ করেন। এটি মূলত দু’টি গ্রিক শব্দ অ্যান্থোস অর্থ ফুল এবং ক্যানস অর্থ নীল থেকে এসেছে।

অ্যান্থোসায়ানিনের প্রাকৃতিক উৎস রঙিন শাক-সবজি (লাল শাক, লাল লেটুস, কালো বেগুন, লাল সিম ও সিমের বীজ, লাল গোল আলু, লাল মূলা, লাল বরবটি, লাল মিষ্টি আলু, লাল বাঁধাকপি ও লাল ফুলকপি), মসলা (লাল পেঁয়াজ ও কালো কাঁচা মরিচ), দেশি ফল (কালোজাম, করমচা, লাল জামরুল, কলা, আপেল কুল, লটকন ও ডালিম), বিদেশি ফল (ব্লুবেরি, বিলবেরি, ব্লাককারেন্ট, ব্লাকবেরি, ক্রানবেরি, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, গুজবেরি, কালো আঙুর, চেরি, পিচ ও নেকটারিন)।

অ্যান্থোসায়ানিন নামক উদ্ভিজ্জ রঞ্জকটির প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমাগত বেড়ে চলছে। এর প্রধান কারণ হলো এটি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মানবদেহে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। গত দু’দশক ধরে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা গেছে, অ্যান্থোসায়ানিন মানবদেহে ক্যানসার, হৃদরোগ, নিউরোডিজেনারেটিভ ব্যাধি, বার্ধক্যজনিত রোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও সিরামে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টর মাত্রা বৃদ্ধি, কোলেস্টেরল বণ্টন, স্থূলতা হ্রাস, দৃষ্টিরোগ পুনঃস্থাপন ও লোহিত কণিকাকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

অ্যান্থোসায়ানিন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানেও চলছে। উদাহরণস্বরূপ বুতেল্লী ও তার সহকর্মীদের ২০০৮ সালের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়। তারা তাদের পরীক্ষায় ক্যানসার সংবেদনশীল ই‍ঁদুর টিআরপি৫৩’ কে উচ্চমাত্রার অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ ট্রান্সজেনিক টমেটো পাউডার এবং একই সঙ্গে কিছু ‘টিআরপি৫৩’ ইঁদুরকে সাধারণ খাবার খাওয়ান, পরবর্তীতে তারা দেখেন ইঁদুরগুলো অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ টমেটো পাউডার খেয়েছিলো তাদের জীবনকাল অন্যগুলোর তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। হ্যান ও তার সহকর্মীরা (২০০৭) দেখতে পান, যে ইঁদুরকে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ লাল আলু খাওয়ালে এরা কোলেস্টেরল খাবার দ্বারা সৃষ্ট অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।

অ্যান্থোসায়ানিনের স্বাস্থ্য গুণাগুণ বিবেচনা করে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী উচ্চমাত্রায় অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ ট্রান্সজেনিক আপেল উদ্ভাবন করেছেন। এ ফলগুলোর গায়ে ও ভিতরে সাধারণ আপেলের তুলনায় অনেকগুণ বেশি অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি হওয়ায় এদের বর্ণ লাল।

অ্যান্থোসায়ানিনের এসব স্বাস্থ্য উপকারী গুণাগুণ বিবেচনা করে বর্তমানে এটি ক্যাপসুল হিসেবে বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। সর্বপ্রথম ২০০১ সালে নরওয়ে ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘বায়োলিংক গ্রুপ’ বিলবেরি ও ব্লাক কারেন্টের নির্যাস থেকে ওষুধ হিসেবে অ্যান্থোসায়ানিন ক্যাপসুল ‘ম্যাডক্স’ প্রস্তুত করেন। প্রাথমিকভাবে শুধু নরওয়েতে বাজারজাতকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের প্রথমদিকে আমেরিকায় বাজারজাতকরণের জন্য ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ এর অনুমোদন লাভ করে।

বাংলাদেশে এ রকম অ্যান্থোসায়ানিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ অনেক শাক-সবজি, ফলমূল, দানাজাতীয় ও কন্দাল ফসল রয়েছে। যেগুলো দামে অত্যন্ত সস্তা ও সহজলভ্য। সুতরাং, এসব ফসল শনাক্ত করে জনসাধারণের মাঝে অ্যান্থোসায়ানিনের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব।

লেখক
ড. মোঃ আব্দুর রহিম
সহযোগী অধ্যাপক ও অ্যান্থোসায়ানিন গবেষক
কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
শেরে বাংলা নগর
ঢাকা-১২০৭।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।