ঢাকা: শিশু হাসপাতালের বাদশা খালেদ আউটডোর। ভাঙা ছাউনি দিয়ে উঁকি দেওয়া সূর্যের আলোয় টিনের ছাউনির দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না।
ভেতরে ডাক্তারের চেম্বারের সামনের চেয়ারগুলোতে অপেক্ষমান শিশু ও অভিভাবক। পাশের ছোট করিডোরের মতো জায়গাটিতে লাইনে শিশু কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো কয়েকজন নারীকে। জানা গেলো চিকিৎসকের জন্য নয়, লাইন টয়লেটে যাওয়ার। প্রতিদিন শত শত রোগীর ব্যবহারের জন্য টয়লেট বলতে একটি।
বুধবার (১৬ নভেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, ব্লক বি’র আউটডোরের অবস্থা আরো শোচনীয়। সেখানে ডাক্তার দেখাতে আসা রোগীদের জন্য নেই টয়লেটের ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে কারও টয়লেটের প্রয়োজন হলে ব্যবহার করতে হয় ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাথরুম।
কৌতুহলবশত টয়লেটে উঁকি দিয়ে দেখা গেলো, স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিজেদের প্রয়োজন সারছেন রোগীসহ তাদের অভিভাবকরা। যেখানে বেসিনগুলো নোংরা। পাশেই রাখা হয়েছে ময়লা-আবর্জনা। পানি পড়ে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে পুরো মেঝটি। নাকের ডগায় দুর্গন্ধ ভনভন করছে।
ওয়ার্ডগুলোতে দেখা যায়, ছয়শ’ টাকা মূল্যমানের ভাড়া বেডগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও উল্টোচিত্র বিনামূল্যে পাওয়া বেডগুলোতে। শয্যা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, আসবাবপত্র, দেয়াল সবকিছুতেই অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মুনিয়া নামের এক শিশুকে চার নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করেন তার মা। তিনি জানান, ‘প্রথমে তিন তলায় বাচ্চারে ভর্তি করাইছিলাম। অনেকদিন থাকনের পর বেড ভাড়া দিতেই সব ট্যাকা শেষ হইয়া গেছে। পরে ডাক্তাররে কইয়া এই বেড লইছি। এখন বেড ভাড়া দিতে হয় না। তয় খাওন-দাওন, ওষুধপত্র কিনতে অনেক ট্যাকা লাগে’।
শেওড়াপাড়া থেকে এক মাসের শিশুকে নিয়ে এসেছেন রোকেয়া বেগম। তিনি জানান, ‘অপারেশনের জন্য আমাদের দু’মাস অপেক্ষা করাইছে। এ দুই মাসে বেড ভাড়া গুনতে হইছে অনেক টাকা। ওষুধের দাম ধরলে টাকার হিসাব করা মুশকিল। সরকারি হাসপাতালে আইসাও যদি এতো টাকা গোনন লাগে তাইলে ক্লিনিকে যাওনই ভালো’।
ভর্তিরত অন্য রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, শুধু বেড ভাড়াই নয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি আদায় করা হচ্ছে অন্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই। এ হাসপাতালের আরেকটি বড় সমস্যা হলো সিটিস্ক্যান এবং এমআরআই করার ব্যবস্থা নেই। ফলে কোনো শিশুরোগীকে এ দু’টি পরীক্ষা দিলে চিকিৎসকরা রোগীদের অবিভাবকদের দেখিয়ে দেন পাশের একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক। এছাড়াও চিকিৎসক সংকটের কারণে অস্ত্রোপচারের জন্য শিডিউল নিতে বেশ বেগ পেতে হয় রোগীদের।
‘এ’ ব্লকের তিন তলায় তিন নম্বর ওয়ার্ডের শিশু সুমনের বাবার কাছে অভিযোগ পাওয়া গেলো অ্যাম্বুলেন্সের। তিনি বলেন, আমার বাচ্চার গত পরশু অপারেশন হইছে। অপারেশনের দিন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অনেক চেষ্টা করেও পাইনি। একটা অ্যাম্বুলেন্স তাও ব্যবহার হয় চিকিৎসকদের কাজে।
সবশেষ গত বছর হাসপাতালটিতে ২০ শয্যার একটি ওয়ার্ড উদ্বোধন করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। কিন্তু সুযোগ বাড়লে কি হবে, সেবার মানে থেকে যাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন।
হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে ছুটিতে থাকার দোহাই দেন উপ-পরিচালক ড. হোসাইন শহীদ কামরুল আলম।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আজকের অবস্থার কথা আমি বলতে পারবো না, কারণ আমি ছুটিতে। সাধারণত এ সমস্যাগুলো হওয়ার কথা নয়। আমরা খুব ভালোভাবে নার্সসহ অন্য কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকি।
ভাড়াসহ অন্য খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাড়ার অভিযোগটা মোটেও সত্যি নয়। আমরা প্লেন বেডে ভাড়া নিয়ে থাকি। কিন্তু বিনামূল্যের বেডে থাকলে তাকে খাবার সরবরাহ করে থাকি। এছাড়াও সাধারণ ওষুধগুলো দেওয়া হয়।
হাসপাতালের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের এমআরআই এবং সিটিস্ক্যান নেই। হাসপাতালের বেডের তুলনায় ডাক্তার-নার্স অপ্রতুল। তারপরও রোগীদের শতভাগ সেবা প্রদানে আমরা বদ্ধপরিকর। তবে ৪০ বছরের বিল্ডিং রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৬
জেডএফ/আরআইএস/জেডএস