ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

পুষ্টি কর্মসূচিতে সয়াবিনের অন্তর্ভুক্তি সময়ের দাবি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
পুষ্টি কর্মসূচিতে সয়াবিনের অন্তর্ভুক্তি সময়ের দাবি সয়াবিন। ফাইল ফটো

সময়ের বিবর্তনে বেড়েছে মানুষের চিন্তা শক্তি, পাল্টেছে রুচি। অগ্রসর মানুষ এখন আর শুধু খিদে মেটানোর জন্য খাদ্য গ্রহণ করে না। সচেতন মানুষ এখন ডাইনিং টেবিলে বাহারি খাবারে খোঁজে সুস্বাস্থ্যের বৈভব। সেটা বাংলাদেশেই হোক, আর বিশ্বের যে কোন উন্নত দেশেই হোক। আর তাই, খাদ্য তৈরির উপকরণ নির্বাচনে মানুষ আগের থেকে অনেক বেশী সচেতন হয়েছে।

খাবার শুধু সুস্বাদু করা নয়, একই সাথে ব্যবহৃত উপকরণটি স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কিনা সে বিষয়েও এখন খেয়াল রাখতে হয়। কারণ গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে যে, খাদ্যের বিশেষ উপাদানের আধিক্যের কারণে অনেক প্রাণঘাতি রোগ হতে পারে।

আবার খাদ্য বিশেষজ্ঞরা এ কথাও বলেন যে, বিশেষ কোন খাদ্য অথবা খাদ্য উপাদান মানুষের অনেক প্রাণঘাতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা প্রদান করে। সয়াবিন হল এ ধরনের একটি খাদ্য উপাদান যা শুধু পুষ্টির দিক দিয়েই অনন্য নয়, অনেক ভয়ানক রোগ প্রতিরোধেও এর রয়েছে অসীম ক্ষমতা।

প্রাচীন চীনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেও সে দেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় সয়াবিন একটি পবিত্র ফসল হিসাবে বিবেচিত হতো। সয়াবিন থেকে উৎপাদিত দুধ অথবা তফু অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। কৃষি ও খাদ্য ভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে নানাবিধ খাদ্য উপকরণ আবিস্কারের কারণে সমগ্র বিশ্বের মানুষ বিভিন্ন প্রকারে খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্থ হয়ে উঠলেও চীনসহ দূর প্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে সয়াবিনের গুরুত্ব একটুও কমেনি।

এবার আসা যাক সয়াবিনের পুষ্টিগুণের কথায়। খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম সয়াবিনে রয়েছে খাদ্যশক্তি ৪৩৬ (কি.ক্যালরি), আমিষ বা প্রোটিন ৪৩ (গ্রাম), তেল ২০ (গ্রাম), শর্করা ৩৩ (গ্রাম), আঁশ ৩.৭ (গ্রাম), খনিজ দ্রব্য ৪.৬ (গ্রাম)। এছাড়াও যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন, থিয়ামিন ও রাইবোফ্লাভিন রয়েছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সয়াবিনের প্রোটিন নিয়ে। উন্নত মানের সয়াবিন থেকে আমরা ৪২-৪৪ ভাগ প্রোটিন পেয়ে থাকি। যা অন্যান্য তৈল বিজে (সরিষা, চীনাবাদাম, তিল সূর্যমুখী, তিসি ইত্যাদি) প্রাপ্ত প্রোটিনের দ্বিগুণ।

সয়াবিন।  ফাইল ফটো সয়াবিনের এই বিশেষত্বই সয়াবিনকে অনন্য সাধারণ মানব জীবন রক্ষাকারী বস্তুতে পরিণত করেছে। সয়াবিন থেকে প্রাপ্ত প্রোটিনকে সয়াপ্রোটিন বলা হয়। এ প্রোটিন আবার অনেক ভাবেই ব্যবহার করা যায়। পুষ্টিমানের দিক থেকে এ প্রোটিন প্রাণীজ প্রোটিনের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। সয়াপ্রোটিন ম্যাক্রো পুষ্টি ও মাইক্রো পুষ্টির একটি উন্নত উৎস। সয়াপ্রোটিন দিয়ে খুব ভাল মানের দুগ্ধ জাতীয় খাদ্যের বিকল্প খাদ্য তৈরি করা যায়।

খাদ্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সয়াপ্রোটিনের পুষ্টিমান অনেক উন্নত এবং দুধ ও ডিমের প্রোটিনের সমতুল্য। আমাদের দেশে যেখানে মায়েদের অপুষ্টির কারণে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ শিশু জন্মের সময় কম ওজন নিয়ে জন্মায় (২.৫ কেজি), সেখানে বিভিন্ন খাদ্যে সয়াপ্রোটিন ব্যবহারের মাধ্যমে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব।

সার্বিক বিষয় আলোচনা করলে দেখা যায় যে, সয়াবিন থেকে প্রাপ্ত আইসোলেটেড সয়াপ্রোটিনের নিয়মিত ব্যবহারে নিম্নলিখিত রোগগুলো প্রতিরোধ হয়:
১.    ক্যালসিয়াম চ্যানেল ইনহিবিটার ক্ষমতা থাকার ফলে সয়াপ্রোটিন উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।
২.    রক্তে এল.ডি.এল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমানো ও এইচ ডি এল এর মাত্রা বাড়ানোর ক্ষমতা থাকার ফলে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি জনিত হৃদরোগ হওয়ার হাত থেকে আইসোলেটেড সয়াপ্রোটিন ব্যবহারকারীদের রক্ষা করে।
৩.    এ্যান্টি অক্সিডেন্ট ক্ষমতা থাকার ফলে আইসোলেটেড সয়াপ্রোটিন হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের হাত থেকে সয়া প্রোটিন ব্যবহারকারীদের রক্ষা করে।
৪.    মহিলা হরমোন ইসট্রোজেনের মতো ক্ষমতা থাকায় মহিলাদের ইসট্রোজেন ঘাটতিজনিত সমস্যায় (ম্যানপোজ) আইসোলেটেড সয়াপ্রোটিন কার্যকরী ভূমিকা রাখার ফলে মহিলারা স্বাস্থ্য জটিলতার হাত থেকে রক্ষা পান।
৫.    আইসোলেটেড সয়াপ্রোটিন মান সম্মত পুষ্টিকর হওয়ার ফলে যে কোন অপুষ্টিজনিত রোগে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৬.    গবেষণায় দেখা গেছে, সয়াপ্রোটিন বেশ কিছু ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে।
৭.    ইদানিং ডায়াবেটিস রোগের ক্ষেত্রেও সয়াপ্রোটিনের ব্যবহার ডায়াবেটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

সয়াবিন।  ফাইল ফটো আইসোলেটেড সয়াপ্রোটিন সরাসরি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা য়ায় না। এই প্রোটিন প্রচলিত খাদ্যের সাথে মিশিয়ে খাদ্যের মানকে উন্নত করা হয়। প্রচলিত আটার সাথে সয়া আটা মিশিয়ে আটার পুষ্টিমানকে বাড়ানো হয়। সয়াসমৃদ্ধ আটা দিয়ে রুটি, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি বিশ্বের অনেক দেশে প্রস্তুত করা হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশে সয়া দুধ উন্নত পুষ্টিযুক্ত খাবার হিসাবে জনপ্রিয়। শিশুদের ডায়ারিয়ায় সয়াপ্রোটিন যুক্ত ‘খাবার স্যালাইন’ পানি ঘাটতি দূর করাসহ পুষ্টিযুক্ত খাবার হিসাবে ব্যবহার হয়।

আমাদের দেশে সয়াবিন শুধু মাছ ও মুরগীর খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু মানব স্বাস্থ্য উন্নয়নে সয়াবিনের ব্যাপক অবদানের বিষয়ে আমরা এখনও সচেতন নই। উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় সয়াবিনের এর উপজাত খাদ্যবস্তু অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে পুষ্টি ও মানব জীবন রক্ষায় সয়াবিনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে একটি সয়াবিন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা।

বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বহু সংস্থা পুষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও সয়াবিনের নাম গন্ধও খুঁজে পেলাম না। তাই আবেদন জানাবো, পুষ্টি উন্নয়ন কর্মসূচিতে সয়াবিনকে অন্তর্ভুক্ত করে ঘাতক ব্যাধি থেকে মানব স্বাস্থ্যকে রক্ষা করুন।

লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই, নোয়াখালী

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।