ঢাকা, সোমবার, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় রঙিন শাকসবজি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৭
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় রঙিন শাকসবজি সবজি। ফাইল ফটো

জীবন বাচাঁতে আমরা অনেক ধরনের খাদ্য খাই। আমাদের খাদ্য তালিকার বিরাট অংশ জুড়ে আছে হরেক রকমের বাহারি (রঙিন) শাকসবজি। এসব শাকসবজি মানব দেহের অপরিহার্য ভিটামিন, খনিজ ও সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটসের অন্যতম উৎস ও যোগানদাতা।

বিশ্বে চীন ও ভারতের পরেই বাংলাদেশ এখন তৃতীয় প্রধান সবজি উৎপাদনকারী দেশ। প্রতি বছর বিশ্বের ৫০টি দেশে প্রায় সাতশত কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হচ্ছে।

পাশাপাশি কৃষি নির্ভর উদ্যোক্তার সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা একদিকে যেমন বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে অর্থনীতির চাকাকেও সচল রাখতে সাহায্য করছে।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কৃষিতে সবজি উৎপাদন একটি বড় অর্জন। সবজি উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রচলিত সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি কেন রঙিন শাকসবজি উৎপাদন করতে হবে সেটা জানা জরুরি।  

ঢাকায় গত ৫-৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ‘জাতীয় সবজিমেলা-১৭’। মেলায় ১৫৬ পদের সবজি প্রদর্শিত হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই একসঙ্গে এত পদের সবজি প্রদর্শিত হয়নি। মানুষের মধ্যেও সবজি মেলা নিয়ে এত সাড়া দেখা যায়নি কখনও। দেশে সবজি উৎপাদনে যে বিপ্লব ঘটেছে-এবারের সবজি মেলা তারই স্বাক্ষর বহন করছে।

জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, গত ৪০ বৎসরে বাংলাদেশে সবজির উৎপাদন পূর্বের তুলনায় পাঁচগুণ বেড়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি মৌসুমী সবজি ছাড়া প্রায় সারা বছরই সব ধরনের সবজি উৎপাদন হচ্ছে, যা আগে কখনো কল্পনাই করা যায়নি। বাংলাদেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থা, প্রযুক্তির ব্যাপকতা, কৃষকের নিরলস শ্রম ও অদম্য আগ্রহ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

জাতীয় সবজিমেলা-১৭ এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “সুস্থ সবল  স্বাস্থ্য চান, বেশি করে সবজি খান”। এ লেখার শিরোনাম দেখে পাঠক অবশ্যই আঁচ করতে পারছেন কোন ধরনের সবজি জীবনের  প্রয়োজনে আমাদের  বেশি করে খেতে হবে। বাহারি সবজি বলতে এখানে রঙিন সবজিকে ইংগিত করা হয়েছে। রঙিন শাকসবজি হচ্ছে অ্যান্থোসায়ানিনের প্রাকৃতিক উৎস। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে, অ্যান্থোসায়ানিন কি ? অ্যান্থোসায়ানিন মানব স্বাস্থ্যের কি উপকার করে? নিম্নে ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হচ্ছে।

অ্যান্থোসায়ানিন: উদ্ভিদ দেহে ক্লোরোফিল ছাড়া অন্যান্য প্রধান উদ্ভিজ্জ রঞ্জকগুলো হলো-ক্যারোটিনয়েড, ফ্লাভোনয়েড এবং বেটালিন। ফ্লাভোনয়েড হচ্ছে উদ্ভিজ্জ সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ গ্রুপ। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ প্রকার ফ্লাভোনয়েড শনাক্ত করেছেন। আর অ্যান্থোসায়ানিন হলো‘ ফ্লাভোনয়েড’ গ্রুপের এক ধরনের উদ্ভিজ্জ বায়োঅ্যাক্টিভ যৌগ যা উদ্ভিদে ও পাতা, ফুল, ফল ও মূলের বর্ণের প্রধান নিয়ামক।

১৮৩৫ সনে জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী  লুড উইং মার্কাট অ্যান্থোসায়ানিনের নামকরণ করেন। এটি মূলত দুটি গ্রিক শব্দ অ্যান্থোস অর্থ ফুল এবং ক্যানস অর্থ নীল থেকে এসেছে। অ্যান্থোসায়ানিন সাধারণত কোষের সাইটোপ্লাজমে তৈরি হয়। এটি পানিতে দ্রবণীয় এবং কোষ গহবরে গিয়ে সঞ্চিত হয়। এটি উদ্ভিদের বিভিন্ন বর্ণ যেমন-কমলা, লাল, গোলাপি এবং নীল বর্ণের জন্য দায়ী। দৃশ্যমান উদ্ভিজ্জ রঞ্জকগুলোর মধ্যে ক্লোরোফিলের পরেই অ্যন্থোসায়ানিনের অবস্থান।

মানব দেহে অ্যান্থোসায়ানিনের প্রভাব: অ্যান্থোসায়ানিন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানেও চলছে। গত দু’দশক ধরে বিশ্ব জুড়ে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলাফলে অ্যান্থোসায়ানিনের নিম্নে বর্ণিত প্রভাব/উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়েছে- (১) অ্যান্থোসায়ানিন একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মানব দেহে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। (২) অ্যান্থোসায়ানিন মানব দেহে ক্যান্সার, হৃদরোগ, নিউরোডি জেনারেটিভ ব্যাধি, বার্ধক্যজনিত রোগের ঝুঁকি কমায়। (৩) সিরামে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের মাত্রা বৃদ্ধি, কোলস্টেরল বণ্টন, স্থূলতা হ্রাস, দৃষ্টিরোগ পুনঃস্থাপন ও লোহিত কণিকাকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

প্রকৃতিতে অ্যান্থোসায়ানিনের  প্রভাব: অ্যান্থোসায়ানিন উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফলকে বর্ণিল করে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ এবং প্রাণীকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে পরাগায়ন ও প্রাকৃতিকভাবে বীজ বিস্তারে সাহায্য করে। (২) অ্যান্থোসায়ানিন আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উদ্ভিদ কূলকে রক্ষা করে।

যে সবজিগুলোতে অ্যান্থোসায়ানিন পাওয়া যাবে: অ্যান্থোসায়ানিনের প্রাকৃতিক উৎস হচ্ছে রঙিন শাকসবজি। যেমন- লালশাক, লাল মুলা, লাল বরবটি, লাল মিষ্টি আলু, লাল গোল আলু, গাজর, ব্রকলি, গোলাপী শালগম, লাল শিম ও শিমের বীজ, লাল লেটুস, লাল বাধাকপি, লাল ফুলকপি, কালো বেগুন, লাল ও কালো বর্ণের টমেটো এবং লাল ও হলুদ রঙের ক্যাপসিকাম ইত্যাদি।

উন্নত বিশ্বে অ্যান্থোসায়ানিনের ব্যবহার: বিশ্বে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও আমেরিকায় বহুপূর্ব থেকেই অ্যান্থোসায়ানিনের ব্যবহার শুরু করেছে। অ্যান্থোসায়ানিনের স্বাস্থ্য গুণাগুণ বিবেচনা করে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী উচ্চ মাত্রায় অ্যান্থোসায়ানিন  সমৃদ্ধ ট্রান্সজেনিক আপেল উদ্ভাবন করেছেন। এ ফলগুলোর গায়ে ও ভেতরে সাধারণ আপেলের তুলনায় অনেক গুণ বেশি অ্যান্থোসায়ানিন  তৈরি হওয়ায় এদের বর্ণ লাল। বর্তমানে এটি ক্যাপসুল আকারে বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। সর্বপ্রথম ২০০১ সালে নরওয়েভিত্তিক প্রতিষ্ঠান  ‘বায়োলিংক গ্রুপ’ অ্যান্থোসায়ানিন ক্যাপসুল ‘ম্যাডক্স’ প্রস্তুত করেন এবং প্রাথমিকভাবে নরওয়েতে বাজারজাতকরণ করা হয়। পরে ২০০৭ এর প্রথম দিকে আমেরিকায় বাজারজাতকরণের জন্য ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন’ কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে।

বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে অ্যান্থোসায়ানিন নিয়ে করণীয়:  বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবজি বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টার ও বিএডিসির বীজ উৎপাদন খামারগুলো এ বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিতে পারেন। এর মধ্যে দেশের কিছু এলাকায় বিশেষ করে বগুড়া, সাভার, নরসিংদীর অগ্রসর শিক্ষিত চাষিরা স্বল্প পরিসরে হলেও লাল মুলা, লাল বরবটি, লাল বাধাকপি ও ফুলকপি গোলাপী শালগম, লাল ও হলুদ রঙের ক্যাপসিকাম, কালো বেগুন, ব্রকলি ইত্যাদি উৎপাদন করে অভিজাত এলাকায় বিক্রি ও হোটেলে সরবরাহ করছে। উৎপাদনের বিরাট একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এটাও আশার আলো। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রঙিন সবজির অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন উপযোগিতা যাচাই করার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। সাথে সাথে রঙিন সবজির উন্নত ও অধিক উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবন করার ব্রিডিং কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারেন।

অ্যান্থোসায়ানিনের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচলিত সবজির পরিবর্তে রঙিন সবজির আবাদ ও খাদ্য তালিকায় রঙিন সবজির অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা শুরু করা যেতে পারে। গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অ্যান্থোসায়ানিনের উপকারিতা বিষয়ে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার সহায়তা কাজে লাগানো যেতে পারে। অন্যান্য সবজি খাওয়ার সাথে সামান্য পরিমাণ হলেও রঙিন সবজি গ্রহণে ভোক্তাদের উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। এলাকাভিত্তিক চাহিদার আলোকে রঙিন সবজি উৎপাদন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পূর্বে বলা হয়েছে, সবজি উৎপাদন ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানোর প্রয়োজনে সবজির উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, সবজির উৎপাদন হতে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছুতেই প্রতি বছর প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ সবজি নষ্ট হয়ে যায়। এটা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

পুষ্টিবিদদের মতে, একজন মানুষের প্রতিদিন ২২০-২২৫ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের লোকজনের খাদ্য তালিকায় এখনো সবজির পরিমাণ মাত্র ৭০-৯০ গ্রাম। অর্থনৈতিক বিবেচনায় প্রচলিত সবজির চেয়ে রঙিন  সবজির দাম ২-৩ গুণ বেশি। কাজেই রঙিন সবজি চাষাবাদ করে কৃষকদের আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং অ্যান্থোসায়ানিনের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব।

ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই, নোয়াখালী

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।