ঢাকা: বিগত কয়েক মাস ধরে দেশে করোনার টিকার আমদানি নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছিল। অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) ভারত থেকে উপহার হিসেবে দেশে আসছে করোনার টিকার প্রথম চালান।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২০ লাখ ডোজ টিকা দুপুরে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছাবে। সেখান থেকে টিকা নিয়ে রাখা হবে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ইপিআইয়ের স্টোরেজে।
তাছাড়া বুধবার এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, উপহারের ২০ লাখ ডোজ টিকা ছাড়াও এদিন ভারত থেকে করোনা ভাইরাসের আরও ১৫ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসছে। সে হিসেবে এদিন দেশে মোট ৩৫ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের কেনা ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসবে ২৫ জানুয়ারি।
বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২৫ জানুয়ারি বেক্সিমকোর মাধ্যমে কেনা টিকার চালান এলে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। ২৭ কিংবা ২৮ জানুয়ারি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২০-২৫ জন মানুষকে টিকা দিয়ে কর্মসূচি শুরু হবে। ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরুর আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৪০০-৫০০ জনকে টিকা দিয়ে সাতদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুসারে টিকার (ভ্যাকসিন) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করে বেক্সিমেকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে চুক্তি অনুযায়ী টিকা জেলায় জেলায় পাঠানো হবে।
স্বাস্থ্যসচিব মো. আবদুল মান্নান বলেছেন, ভারতের শুভেচ্ছা উপহারের ২০ লাখ ও বাংলাদেশ সরকারের কেনা ৫০ লাখ ডোজ মিলিয়ে মোট ৭০ লাখ ডোজ টিকার মধ্যে প্রথম মাসে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। এভাবে দ্বিতীয় মাসে ৫০ লাখ এবং তৃতীয় মাসে আবার ৬০ লাখ নাগরিককে টিকা দেওয়া হবে। প্রথম মাসের ৬০ লাখের দ্বিতীয় ডোজ সংরক্ষিত থাকবে এবং প্রথম মাসে টিকা পাওয়া ব্যক্তিরা ফের তৃতীয় মাসে টিকা পাবেন।
স্বাস্থ্যসচিব বলেন, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে উপজেলা ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে টিকা দেওয়া হবে। পরে সারাদেশে এ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। টিকা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। টিকা সংরক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কোল্ড স্টোরেজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
করোনার টিকা শুধু সরকারি হাসপাতালগুলোতে দেওয়া হবে। দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এ টিকা দেওয়া হবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে টিকা নিয়ে যদি কারও মৃত্যু হয়, সে দায় সেই হাসপাতালের। সরকার সে দায় নেবে না বলেও সতর্ক করেন স্বাস্থ্যসচিব।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক জুয়েনা আজিজ বলেন, বিমানবন্দরে টিকার চালান গ্রহণ করা থেকে শুরু করে সারা দেশে এ বিষয়ে পুরো নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। টিকা যেখানে সংরক্ষণ করা হবে, সেখানেও তারা থাকবেন। এমনকি ঢাকা থেকে যখন বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়া হবে, তখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবে। যখন টিকা দেওয়া হবে, তখনও সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবে, যাতে মানুষ অযথা ভিড় না করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সব টিকার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। জ্বর, গায়ে ব্যথা, টিকা দেওয়া জায়গা হালকা ফুলে যেতে পারে। কিন্তু এনাফাইলিপিসের যে চিন্তা করা হচ্ছে, তা এ পর্যন্ত কোনো টিকাই হয়নি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিকে সেবা দিতে হাসপাতালেই টিকাদান কেন্দ্র করা হয়েছে। টিকা দেওয়ার পর ওই ব্যক্তি ১০-১৫ মিনিট ওখানেই অবস্থান করবেন। টিকাদান কেন্দ্রে ভিড় করা যাবে না, দর্শনার্থী হয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। তাদের সার্বিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে, টেলিমেডিসিন সেবার ব্যবস্থা থাকবে। তাই অহেতুক বিভ্রান্তি, গুজব ছড়িয়ে অনাস্থা তৈরি করা যাবে না।
মহাপরিচালক বলেন, ১৮ বছরের নিচে শিশুরা টিকা পাবে না। গর্ভবতী নারী, ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা টিকা কর্মসূচির বাইরে থাকবে। এছাড়া এক কোটি মানুষ দেশের বাইরে থাকে। সবমিলিয়ে প্রায় সাত কোটি মানুষ টিকা পাবে না। বয়স্কদের টিকা দেওয়া এ কর্মসূচির বড় চ্যালেঞ্জ।
অ্যাপ ব্যবহার করে কীভাবে টিকার জন্য নিবন্ধন করবেন
টিকা পেতে 'সুরক্ষা' নামে অ্যাপে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। এ অ্যাপটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। স্মার্ট মোবাইল ফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ থেকেই নিবন্ধন করতে পারবেন। নিবন্ধনের জন্য ফোন নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, নাম, জন্মতারিখ, অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা আছে কিনা, পেশা ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। প্রত্যেকে করোনা ভাইরাসের দুই ডোজ করে টিকা পাবে। প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের বিস্তারিত তথ্য অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। কারা আগে টিকা পাবে, সেই অগ্রাধিকারের তালিকাটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকেও সংগ্রহ করা যাবে। ২৬ জানুয়ারি থেকে অনলাইনে এ রেজিস্ট্রেশন শুরু হবে।
সরকারি প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৈরি গাইডলাইন মেনে টিকাদান কর্মসূচির সার্বিক প্রস্তুতি চলছে। টিকা বণ্টনের জন্য সারা দেশে তিন স্তরে কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে টিকা বিতরণের জন্য ১৫ ধরনের প্রায় ছয় হাজার ৩০০টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১০ ও ২০ শয্যার হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, জাতীয় সংসদ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সচিবালয় ক্লিনিক ও সিটি করপোরেশন হাসপাতাল। এসব প্রতিষ্ঠানে টিকাদান কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০২১
পিএস/এসআই