ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

ফরিদপুরে অনুমোদন ছাড়াই চলছে হাসপাতাল-ক্লিনিক

হারুন-অর-রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২২
ফরিদপুরে অনুমোদন ছাড়াই চলছে হাসপাতাল-ক্লিনিক

ফরিদপুর: ফরিদপুরে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা ও অনুমোদন ছাড়াই একের পর এক গড়ে উঠছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আবার কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনুমোদন (লাইসেন্স) থাকলেও সেটির মেয়াদোত্তীর্ণ।

অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানে মানা হচ্ছে না কোনো আইন। আবার চিকিৎসার নামে কোনো কোনো হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালের সামনে ও আশে-পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এছাড়া কিছু কিছু হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অপ্রশিক্ষিত নার্স কিংবা আয়া দিয়েই করা হচ্ছে গর্ভবতী মায়েদের সিজার। প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের নাম বলে অপ্রশিক্ষিত ইন্টার্নি চিকিৎসক দিয়েও করা হচ্ছে বড় ধরনের অপারেশন। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেক প্রতিষ্ঠানের তথ্যও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। আবার অবৈধ এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বেশির ভাগেরই নাম ও অবস্থান জানে না জেলা সিভিল সার্জন! 

এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বেতন ভুক্ত দালালরা সরকারি হাসপাতালের রোগীদের ভুলভাল বুঝিয়ে এবং শহর ও গ্রামের ওষুধের দোকানদারসহ পল্লি চিকিৎসকদের রোগী প্রতি মোটা অংকের কমিশন দিয়ে ভাগিয়ে নিচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠানে। সহজ সরল রোগীরা দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সহায় সম্বল বিক্রি করেও সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

গত শনিবার (১৫ জানুয়ারি) ফরিদপুরের আল মদিনা নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে প্রসূতির পেট থেকে বের করার সময় এক নবজাতকের কপাল কেটে ফেলে এক অপ্রশিক্ষিত নার্স। পরে এ ঘটনা নিয়ে ফরিদপুরসহ সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হয়। পরে এ ঘটনায় নড়ে-চড়ে বসে স্বাস্থ্য বিভাগ।

এদিকে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের মতে, জেলায় প্রায় তিন শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে জেলা শহরেই রয়েছে এমন ধরনের প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। যাদের অনেকেরই প্রয়োজনীয় বৈধ অনুমোদন নেই।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, অনেকে এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনের আবেদন করে অনুমোদনের অপেক্ষা না করেই চালু করে দিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে জেল, জরিমানা ও বন্ধ করে দেওয়ার পরেও এসবের লাগাম টানা যাচ্ছে না।

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘিরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু খোঁজ-খবর না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা তারা করে না। সর্বত্রই সরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি গড়ে ওঠা দালাল নির্ভর এসব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। এতে সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

বর্তমানে একটি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রায় ২১টি ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স বা ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে এসব লাইসেন্স যেমন পেতে হয়, তেমনি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে লাইসেন্সগুলো নবায়নও করতে হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া আরও যেসব লাইসেন্স নিতে হয় তার মধ্যে রয়েছে- মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সাভিসের লাইসেন্স, ফার্মেসি পরিচালনার জন্য লাইসেন্স, পরিবেশ লাইসেন্স, জেনারেটর লাইসেন্স, ব্লাড ব্যাংক লাইসেন্স, বয়লার লাইসেন্স, ক্যাফেটেরিয়া ও লন্ড্রি লাইসেন্স, কমর্শিয়াল লাইসেন্স, বিএসটিআই লাইসেন্স (বেকারি), ট্রেডমার্ক লাইসেন্স (বেকারি), গভীর নলকূপ লাইসেন্স, আণবিক শক্তি কমিশন লাইসেন্স, আরসিও লাইসেন্স, মেডিক্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট লাইসেন্স, নারকোটিকস লাইসেন্স, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এনওসি ইত্যাদি।

ফরিদপুরের অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের এসব অনুমোদন নেই। বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য বিভাগ ও র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। আটক করেও জেলে পাঠায় এবং জরিমানার ও দণ্ড দেওয়া হয়। অভিযুক্ত ক্লিনিকগুলো সিলগালাও করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন কৌশলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচলই থাকছে।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. আব্দুল জলিল বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সরকারের নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার কথা। যখন একজন রোগী আসবে তখন প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্স উপস্থিত থাকবে। সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য শর্তাদি মানতে হবে। যেসব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ নিয়ম মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবো। আমরা এসব বিষয় তদন্ত করে দেখবো।

ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ছিদ্দীকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অনেক সময় অনুমোদনের আবেদন করার পর অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকেই এসব প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু করে দেওয়া হয়। আমরা বিভিন্ন সময় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও অনেক ক্ষেত্রে সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেই।

শনিবার (১৫ জানুয়ারি) ফরিদপুরের আল মদিনা প্রাইভেট হাসপাতালে প্রসূতির পেট থেকে বের করার সময় এক নবজাতকের কপাল কেটে ফেলা ঘটনা প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন ডা. ছিদ্দীকুর বলেন, ওই হাসপাতালটি নবায়নের কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। এমন আরও অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে যাদের কাগজপত্র ঠিক নেই। এ ব্যাপারে আমরা জোরদার অভিযান চালাবো। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২২
আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।