কলকাতা: সম্প্রতি ভারতের সংসদ ভবনের দুই কক্ষে (লোকসভা এবং রাজ্যসভা) পাস হয়েছে বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরে সেই বিল আইনে পরিণত হয়েছে।
সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় দেশটিতে আন্দোলন-প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। মুসলিম সংগঠনগুলোর পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির মতো রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আর এর আঁচ এসে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গসহ কলকাতায়। এর জেরে মুর্শিদাবাদে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ বাধে। সেখানে জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা।
নতুন ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় সরব পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন। সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ প্রতিরোধে কলকাতার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে। এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতাও কোনো কথা বলছেন না। আর এই পরিস্থিতিতে আইনের বদল না হলে বড় আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে হুগলি জেলায় অবস্থিত ফুরফুরা শরিফের পীর সাহেবরা।
বুধবার (৯ এপ্রিল) এক বৈঠকের মধ্য দিয়ে ফুরফুরা শরিফ নতুন ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পীরজাদা ইমরান সিদ্দিকী, মেহরাব সিদ্দিকী, কাশেম সিদ্দিকী, সওবান সিদ্দিকীসহ একাধিক পীরসাহেব। তাদের অভিমত, এই আইন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকারকে লঙ্ঘন করছে।
তাদের ঘোষণা, ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে। সেই আন্দোলনে কলকাতাকে পাখির চোখ করেছেন তারা। শহরে বৃহত্তর জমায়েত করা হবে বলে জানিয়েছেন, পীরসাহেবরা। পাশাপাশি বাংলার সাধারণ মানুষকে সচেতন করাও তাদের আন্দোলনের অংশ হবে জানানো হয়েছে।
এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গণশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী তথা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, তারাও পৃথকভাবে শিয়ালদাহ সংলগ্ন মৌলালীর রামলীলা ময়দান থেকে আন্দোলনে নামছেন।
সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ওয়াকফ মুসলমানদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন শরিয়ত অনুযায়ী, ইসলামের সাথে ওয়াকফ থাকবে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আরবের দেশগুলো সর্বত্রই ওয়াকফ আছে। গোটা বিশ্বেই রয়েছে। তাহলে ভারতের আইনের সংশোধন হলো কেন? এতে ভারতীয় গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, ভারতবর্ষের সম্প্রীতি সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ওয়াকফের মধ্যে মসজিদ, কবরস্থান, ঈদগা জাতীয় সম্পদ সব পড়ে।
রাষ্ট্রপতির দ্রুত স্বাক্ষরের বিষয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি যেন একপক্ষের হয়ে গেছেন। এতে গণতন্ত্র সমস্যায় পড়ছে। ভারতবর্ষ নিয়ে আমাদের কথা বলার অধিকার রয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতায় মুসলমানদের অবদান কম নয়। আমরাও আন্দোলন করে দেশকে স্বাধীন করেছি। তাই আমাদেরও গলার জোর রযেছে। সংবিধানকে বাঁচাতে প্রাণ দিতে রাজি আছি।
গত ৩ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন একত্রিত হয়ে কলকাতার রাজপথে বিক্ষোভ করে। সংগঠনগুলো এসপ্ল্যানেডের টিপু সুলতান মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল নিয়ে মার্কিন দূতাবাস অবধি যায়। সেখানে বিক্ষোভ করে। ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষের ওপর ইসরায়েলের নৃশংস হামলা এবং ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহার ও জাতির নামে বিভাজনের প্রতিবাদ জানায়।
ওয়াকফ আইন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায়। মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বিক্ষোভকারীরা ওই জেলার রঘুনাথগঞ্জের ১২ নং জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দেন। পুলিশ এসে অবরোধ তোলার চেষ্টা করতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশের বিরুদ্ধে লাঠিচার্জের অভিযোগ করেন বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে টিয়ারশেল ছোড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর সঙ্গলবার থেকে ৪৮ ঘণ্টার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।
এ ঘটনার খবর পাওয়ার পর ওই অঞ্চলেরর তৃণমূল বিধায়ক জাকির হোসেনকে কল করে পরিস্থিতির খবর নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, পুলিশের লাঠিচার্জে ২৫ জন গুরুতর জখম হয়েছেন। অন্যদিকে, বিক্ষুব্ধ জনতার বিরুদ্ধে পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ হয় বলে প্রশাসনের তরফে দাবি করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থে মুর্শিদাবাদের ওমরপুর থেকে জঙ্গিপুর শহর এলাকা সর্বত্র নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। রঘুনাথগঞ্জ, সুতিতে ১৪৪ জারি করা হয়েছে।
একই ভাবে রাজ্যটির পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট শহরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে সংশোধিত ওয়াকফ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ-মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা নয়া আইনকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থি এবং ধর্মীয় সম্পত্তির ওপর হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।
মিছিলে উপস্থিত ছিলেন ঐকতান মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক মাওলানা আমিনুল আম্বিয়া, মুসলিম ইত্তেহাদুল মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক মাওলানা হাবিবুর রহমান, সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের রাজ্য সহ-সভাপতি শেখ ফজলুর রহমান, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সংখ্যালঘু জেলা সম্পাদক হামিদুল হোসেন, সংখ্যালঘু কাউন্সিলের জেলা সম্পাদক মনিরুল হক, সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের ব্লক সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন, সংখ্যালঘু কাউন্সিলের জেলা সহসভাপতি ডা. মোজাফফর আলি খান, শেখ সাজাহান প্রমুখ।
বক্তারা নতুন ওয়াকফ আইনের তীব্র বিরোধিতা করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানান এবং ভবিষ্যতে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন।
ওয়াকফ সম্পত্তি ইসলাম ধর্মে আল্লাহর নামে দানকৃত বলে বিবেচিত হয়, যা বিক্রি করা যায় না কিংবা ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহারযোগ্য নয়। সংশোধিত আইন এই ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বার্থের পরিপন্থি বলে মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিযোগ। ইতোমধ্যে নতুন আইনের বিরুদ্ধে চারটি পিটিশন সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হয়েছে। এআইএমআইএম, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি ও আরজেডি’র নেতারা ছাড়াও একাধিক সিভিল রাইটস সংগঠন নতুন আইনটিকে অসাংবিধানিক এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘনকারী বলে দাবি করেছে। এখন দেখার বিষয় সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কী অবস্থান নেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০২৫
ভিএস/এমজেএফ