ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

বিজয়ার একাল ও সেকাল

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৭
বিজয়ার একাল ও সেকাল বিজয়ার আনন্দ ভাগাভাগি করছেন ভক্তরা

কলকাতা: তিথিমতে দেবী দুর্গার বিসর্জন হলেই মাকে ত্যাগ নয়, বিশেষরূপে অর্জন। এই কদিনের পূজাশেষে যে জ্ঞান অর্জিত হলো, তা হচ্ছে, মা স্বস্থানে কৈলাসে ফিরে গেলেন। চর্মচক্ষের বাইরে চলে গেলেও অন্তর চক্ষুতে মা নিরাকারা এবং অন্তরে বিরাজমান। (সূত্র: প্রাধানিক রহস্য-২৯, চণ্ডী)

আবার মা তথা আমাদের কল্যাণে আবারও আসবেন বছরান্তে রূপাধারে।  বিসর্জন অর্থে আত্মপ্রতিষ্ঠা।

 বিজয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জ্ঞান অর্জন দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে।  এ শুভদিনে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পণ্ডিত-মূর্খ, উঁচু-নিচু বিচার না করেই সকলে একাত্মবোধে আবদ্ধ।  শুভ বিজয়ার তাৎপর্য এটাই।

বিজয়ার আরও একটি তাৎপর্য আছে।  একটা সময় ছিলো মহালয়ার পর থেকেই পরিবারের নারী সদস্যরা শুরুর করে দিতেন বিজয়া দশমীর প্রস্তুতি।  গাছ থেকে নারকেল পাড়িয়ে ঘরে জমা করা, ঘষেমেজে সন্দেশের ছাঁচগুলিকে প্রস্তুত করে রাখা, মিষ্টির জন্য গুড়-চিনি এবং নিমকির জন্য ডালডার টিন মজুত রাখা, মশলার কৌটো গুলিকে সযত্নে পরিপূর্ণ করে রাখা আরও কত কি!

কারণ পূজোর শুরু হতে না হতেই চলে আসে বিজয়া দশমী।  আর দশমী মানে মিষ্টি মুখ।  এখন বিসর্জনের পরেই বাড়ির কর্তাদের লাইন পড়ে মিষ্টির দোকানে।  কলকাতার ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, বনেদি বাড়ির দুর্গা পূজার পর ময়রা এনে বিজয়ার মিষ্টি বানানোর রেয়াজ ছিলো।

তবে বনেদি বাড়ির বাইরেও বিজয়া দশমী বাঙালির কাছে চিরকালই এক মিলন উৎসব বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে।  আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোও দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের পরে বাড়িতে ছোটরা এলে তাদের হাতে অন্তত কয়েকটি গুড়ের নাড়ু তুলে দিতেন।

দোকানে ময়রাদের ব্যস্ততা থাকতো চোখে পড়ার মতো।  ঢাকের বোলে বিদায়ের ছন্দ বাজলেই ময়রাদের কড়াইয়ে তৈরি হওয়া শুরু হতো জিবেগজা,  রসবড়া,  মনোহরা,  মিহিদানা,  সীতাভোগ, পান্তুয়া।

তবে বিজয়া মানেই যে শুধু মিষ্টি তা নয়, কনকাঞ্জলিতে দেবীর বিদায়ের পরই চাটের কড়াই বসতো চুলায়।  বাড়িতে আসা অতিথিদের মিষ্টির প্লেটের সঙ্গে থাকতো চাটের প্লেট।  কোনও কোনও বাড়িতে চাটে মেশানো হতো পাঁঠার মাংস।

আজকের বিজয়া দশমী বদলে গেছে।  কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোতে সেভাবে ময়রা এনে বিজয়ার মিষ্টি আর তৈরি হয় না।  বেশিরভাগ বনেদি বাড়িতেই আজকাল বাজার থেকে কেনা মিষ্টির ব্যবহার করা হয়।

মধুমেহ রোগের কারণে কলকাতায় বড় অংশের মানুষ মিষ্টি খাওয়া নিয়ে অনেকটাই সাবধানী। কবজি ডুবিয়ে খাওয়া তো দূরের কথা আঙুল দিয়ে একটি বা দুটির বেশি মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস প্রায় চলে গেছে।  অনেকে আবার মিষ্টি ছুঁইয়েই দেখেন না।

বাড়িতে ডালডার টিন বর্তমানে আর আসে না, তবে নানা ধরনের ভোজ্য তেল এখনও আসে। অনেক বাড়িতেই বিসর্জনের পরেই শুরু নানা রকম ভাজা পোড়া।  তবে শহরের ছোটছোট পরিবারগুলো এই রেওয়াজ থেকে অনেক দূরে থাকে।

দশমীর পর তারা ঠাণ্ডা নরম পানীয় আর কেনা মিষ্টিতেই কাজ সারেন।  অনেকেই মিষ্টির বদলে পিজা কিংবা কেক, কুকিজেই বিজয়া সারেন।

তবে বিজয়ার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত কুচো নিমকি।  সারা বছর পাওয়া গেলেও বাড়িতে তৈরি কুচো নিমকি পছন্দ করেন না এমন বাঙালি খুজে পাওয়া দুষ্কর।  আজও বেশ কিছু বাড়িতে বিজয়ার পর নিমকি তৈরির প্রথা চালু আছে।

সমাজবিজ্ঞানে বলা হয় একটি জাতির সংস্কৃতির নিউক্লিয়াস তার ঘরোয়া সংস্কৃতি।  বিজয়া দশমী সেই রকমই একটি ঘরোয়া সংস্কৃতি।  যদিও সময়ের সঙ্গে তার বিবর্তন ঘটেছে প্রচুর। দশমীর চিঠির বদলে এখন ওয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে-এ প্রণাম-শুভেচ্ছা সেরে ফেলা হয়।  সে প্রবাসে বা নিজের পাড়া হোক।  সময়ের সাথে সাথে বদলে গেলেও বাঙালির সঙ্গে আজও জুড়ে আছে বিজয়া দশমী।

বাংলাদেশ সময়: ০৬০৩ ঘণ্টা, ১ অক্টোবর, ২০১৭
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।