ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প

সদম্ভে চলছে বিষাক্ত ট্যানারি, স্থানান্তরে নানা অজুহাত

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
সদম্ভে চলছে বিষাক্ত ট্যানারি, স্থানান্তরে নানা অজুহাত ছবি: সুমন-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: রাজধানীর হাজারীবাগের রুপালি কম্পোজিট লেদার। প্রতিদিনের মতোই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ  করা হচ্ছে।

কবে নাগাদ এই ট্যানারিটি সাভারের বিসিক ট্যানারি শিল্পপল্লীতে স্থানান্তরিত হবে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। ট্যানারির কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়া করার ড্রামগুলো (ট্যানিং ড্রাম) সদম্ভে ঘুরছে আগের মতোই।

রুপালি কম্পোজিট লেদারের কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন,  ‘চামড়া শিল্প একটি ভারি শিল্প। কেউ বললেই চোখের পলকে সরাতে পারি না। চামড়া শিল্প আমরা কোথায় সরাবো? সাভারে এখনও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। সেখানে গ্যাস নাই, পানি নাই, বিদ্যুৎও নাই। তাহলে চামড়া নিয়ে আমরা কোথায় যাবো?’
 
কবে নাগাদ শিল্পটি স্থানান্তর করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ আজকে শতভাগ শেষ হলেই কালকে আমরা সরিয়ে নেবো’।
 
রুপালি কম্পোজিট লেদার ট্যানারির কয়েক গজ দূরেই ইব্রাহিম লেদার। এখানেও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের শেষ পর্বের কাজ চলছে আগের মতোই। শ্রমিকেরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানে।
 
কবে নাগাদ ইব্রাহিম লেদার সাভারে স্থানান্তর করা হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ট্যানারিটির চামড়া সিলেকশনের প্রধান ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকার প্রকল্প রেডি করলেই আমরা যেতে প্রস্তুত। সাভারে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ না দিলে আমরা যেতে পারি না। সরকার ‍প্রকল্প রেডি করছে না, খামাখা একটি সময় বেঁধে দিচ্ছে’।

‘আমাদের শিল্পটা ধ্বংস করার জন্যই সরকার হাজারীবাগ থেকে আমাদের সরিয়ে দিচ্ছে’- অভিযোগ তার।
 
হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার কিউবিক লিটার বিষাক্ত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে৷ আর তা দূষিত করে বুড়িগঙ্গার পানি, হাজারীবাগের মাটি ও বায়ু৷ পানি ও পরিবেশের এই মারাত্মক দূষণ রোধ ও এ এলাকার মানুষের দুর্ভোগ ঘোচাতে সাভারে বিসিকের মাধ্যমে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলছে সরকার। সেখানে হাজারীবাগের ১৫৫ ট্যানারি স্থানান্তরের কথা ছিল। কিন্তু বার বার সময় নিয়েও একটি বাদে বাকি ১৫৪টি ট্যানারিই স্থানান্তর করেননি মালিকরা।  
 
হাজারীবাগে ছোট, বড় ও মাঝারি মিলে মোট ট্যানারির সংখ্যা ১৯৪টি। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের ব্যপারে কোনো ট্যানারিই আন্তরিক নয়। সকল ট্যানারিই সদম্ভে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
 
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এসব চামড়ার কারখানায় কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে আগের মতোই। এর প্রভাবে দিশেহারা  এ এলাকার  বাসিন্দারা।

হাজারীবাগ এলাকা খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এবং সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করেন৷ ট্যানারি কারখানায় কঠিন বর্জ্য- যেমন টুকরো চামড়া, গরুর হাড়, চর্বি, দাঁত –পুড়িয়ে পোল্ট্রি ফিডসহ আরো নানা জিনিস তৈরি করা হয়৷ এসব কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া পুরো এলাকাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
 
অথচ ট্যানারির মালিকেরা খোঁড়া যুক্তি দেখাচ্ছেন, ‍হাজারীবাগে ট্যানারি থাকলে শুধু বুড়িগঙ্গা দূষিত হবে। সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরিত হলে চারটি নদী দূষিত হবে।
 
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘বিশ্বের মধ্যে ভারি শিল্পের মধ্যে অন্যতম ট্যানারি শিল্প। এটা তো আর কুঁড়েঘর না যে বলা মাত্রই সরিয়ে ফেললাম। সাভারে এখনও প্রকল্পই শেষ হয়নি, কোথায় ট্যানারি নিয়ে যাবো? এখনও বর্জ্য শোধনাগারই নির্মাণ করা হয়নি। আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, সাভারে ট্যানারি শিল্পের কাজ শুরু হতে আরও বছরখানেক সময় লাগবে। এটা আগামী বছরের জুনেই শেষ হবে। এতো আগে শিল্প স্থানান্তর করে কি আমরা আমাদের ব্যবসা হারাবো?’

‘এই শিল্প একসঙ্গে সরানো কঠিন, ক্রমান্বয়ে স্থানান্তর করা হবে। প্রথমে সাভারে কাঁচা চামড়া থেকে ওয়েট ব্লু করাবো। এ কাজে ৭৫ শতাংশ দূষণ হয়। বাকি কাজগুলো ধীরে ধীরে সাভারে করা হবে’- বলেন তিনি।
 
শাহীন আহমেদ আরও বলেন, ‘হাজারীবাগেও ব্যবসা রানিং রাখতে হবে, সাভারেও শিফটিং করতে হবে। আমাদের ওপর পরিবেশের খড়গ নাজিল হয়েছে। গত ১ এপ্রিল থেকে সরকার কাঁচা চামড়া ঢুকতে দেয়নি। এতে চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ কথা শুনেই বায়াররা অন্য দেশে অর্ডার দিয়েছেন। এতে আমরা চীন, ইতালি ও হংকংয়ের বাজার হারিয়েছি।

‘চামড়া শিল্পে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, শিল্পটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’ বলে মন্তব্য করে তিনি ‘আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোতে চামড়া পাচার হয়ে যাবে’ বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
 
‘শুধু আমরাই বুড়িগঙ্গা দূষণ করছি না। অনেকেই বুড়িগঙ্গা দূষণ করছেন আর খড়গ নাজিল হচ্ছে আমাদের ওপরে। এখন বুড়িগঙ্গা নষ্ট বলে খড়গ নাজিল হয়েছে। সাভারে গেলে চারটি নদী দূষণ হবে, তখন কোথায় যাবো?’

সাভারের হেমায়েতপুরে ২০০ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণাধীন চামড়া শিল্পনগরীতে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি কারখানা স্থাপন করা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিসিক।
 
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দূষণের হাত হাফ ছেড়ে বাঁচবে ঢাকা ও বুড়িগঙ্গা।   প্রকল্প এলাকায় ওয়েস্ট ডাম্পিং ইয়ার্ড, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি), সড়ক, সড়কবাতি, ড্রেন, স্যুয়ারেজ লাইন, ছোট কালভার্ট, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনসহ নানা অবকাঠামোর কাজ চলমান আছে।  

এদিকে ১৪ বছর আগে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও সে আদেশ বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে গত ১৬ জুন হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর না করা পর্যন্ত ট্যানারি মালিকদের প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। হাজারীবাগে থাকা ১৫৪ ট্যানারি মালিকের প্রত্যেককে জরিমানার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।     

২০০১ সালে ট্যানারি সরাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত স্থানান্তরের সময় বেধে দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও ট্যানারি স্থানান্তরিত না হওয়ায় ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে গত বছরের ২১ এপ্রিল আদালতের তলবে হাইকোর্টে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন শিল্পসচিব।

গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর হাজারীবাগে এখনো যেসব ট্যানারি ব্যবসা পরিচালনা করছে তাদের তালিকা চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের এ আদেশ অনুসারে গত ১৬ জুন ১৫৫টি ট্যানারির তালিকা দাখিল করেন শিল্পসচিব। এর মধ্যে কেবল রিলায়েন্স ট্যানারি লিমিটেড ইউনিট-২ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সাভারে স্থানান্তরিত হয়েছে, বাকি ১৫৪টি ট্যানারি সদম্ভে চলছে হাজারীবাগে।  

তবে সাভার চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতাকেই হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর না হওয়ার পেছনে দায়ী করছেন ট্যানারি মালিকরা।  

২০০৩ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) সাভার চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এ শিল্পনগরীর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে।
 
নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১০ সাল পর্যন্ত। তখন ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকায়। এর পরেও কাজ শেষ হয়নি। পরে ব্যয় না বাড়িয়ে আবারও ২০১২ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হলেও কাজ শেষ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন হয় একনেকে। এ সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

প্রকল্পের বর্ধিত এ মেয়াদ চলতি জুন মাসেই শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৩ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর

** হাইকোর্টের আদেশ পেলে ট্যানারির জরিমানার বিষয়ে আপিল
** যেসব ট্যানারি প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা গুনবে
** ট্যানারি না সরালে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা জরিমানা
** হাজারীবাগে থাকা ট্যানারির তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
** ট্যানারি বন্ধ করে অব্যাহতি পেলেন তিন মালিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।