ঢাকা: স্টারলিংক বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে, যা সাফল্যের নির্দেশনা প্রকাশ করে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব।
দেশে যাত্রা শুরুর দিন মঙ্গলবার (২০ মে) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেন।
স্টারলিংক দুটি প্যাকেজ দিয়ে শুরু করছে স্টার লিংক রেসিডেন্স এবং রেসিডেন্স লাইট। মাসিক খরচ একটিতে ছয় হাজার টাকা, অপরটিতে চার হাজার ২০০ টাকা। তবে সেটআপ যন্ত্রপাতির জন্য ৪৭ হাজার টাকা এককালীন খরচ হবে। এখানে কোনো স্পিড ও ডাটা লিমিট নেই। ব্যক্তি ৩০০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতির আনলিমিটেড ডেটা ব্যবহার করতে পারবেন। বাংলাদেশের গ্রাহকরা আজ থেকেই অর্ডার করতে পারবেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিশেষ সহকারী জানান, ৯০ দিন আগে বাংলাদেশে কোনো এনজিএসও লাইসেন্স ছিল না। এ ৯০ দিনের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক দ্রুততার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটা এনজিএসও গাইডলাইন করেছে এবং সেটির অনুকূলে একটা অপারেটর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট অপারেটর আবেদন করেছে এবং সেই আবেদনটাও প্রসেস করে চার মাসের মধ্যে এটা কমার্শিয়াল যাত্রা শুরু করতে পেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের টেলিকমিউনিকেশন লাইসেন্সের রোল আউটের ইতিহাসের প্রথম ও অনন্য ঘটনা।
স্টারলিংকের কী ডাটা লিমিট রয়েছে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিশেষ সহকারী বলেন, না।
স্টারলিংক আসলে আমরা কাদের জন্য করছি? এর সেবা গ্রহীতা কারা সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনো ফাইবার পৌঁছায়নি। মাত্র ৩০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ারে ফাইবার আছে। এমতাবস্থায় মোবাইল কোম্পানিগুলোর যে সেবা দান সেটা মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে হয় যেটা লো ক্যাপাসিটি। বাংলাদেশে এখনো হাজার হাজার মোবাইল টাওয়ার আছে যারা শুধুমাত্র ৩০০ এমবিপিএস এর একটা ব্যান্ডউইথ দিয়ে একটা মোবাইল টাওয়ার সচল রাখে ডেটা ইন্টারনেটের জন্য এবং সেই ডেটা ইন্টারনেটটা প্রায় কয়েক হাজার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয়। স্টারলিংকের ক্ষেত্রে মাত্র একটা সেটআপ বক্স দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে। অর্থাৎ গ্রামের একজন উদ্যোক্তা স্টারলিংকের একটা সেটআপ বক্স যেটার দাম ৪৭ হাজার টাকা। এটা কিনে উনি নিজে নিরবচ্ছিন্ন এবং লো লেটেন্সি অর্থাৎ ডাউনলোড করতে তার কম সময় খরচ হবে। লো লেটেন্সি এবং উচ্চ গতির ইন্টারনেটটা ব্যবহার করতে পারবেন। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, সংসদ ভবনে কিংবা উপদেষ্টার বাসভবন বা তার অফিসে যেই স্পিডে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়, ঠিক একই স্পিডে দেশের প্রত্যন্ত ও দূরবর্তী অঞ্চল যেমন পার্বত্য অঞ্চল, হাওরাঞ্চল কিংবা বনাঞ্চলে যেকোনো গ্রাহক উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। এটি ডিজিটাল বৈষম্য রোধে একটা কার্যকর পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।
স্টারলিংক কি উদ্যোক্তা বান্ধব? উদ্যোক্তারা ইন্টারনেট সেবা প্রদানে কীভাবে স্টারলিংক ব্যবহার করতে পারবেন প্রশ্নের জবাবে বিশেষ সহকারী বলেন, আমরা এনজিএসও'র বিধিবিধান এমনভাবে করেছি যেন স্টারলিংক বা সমজাতীয় ইন্টারনেট সুবিধা উদ্যোক্তা বান্ধব হয়। অর্থাৎ, একজন উদ্যোক্তা কিংবা একাধিক উদ্যোক্তা নিজেরা যদি ৪৭ হাজার টাকার একটা তহবিল গঠন করে, এ তহবিলের মাধ্যমে তারা ইন্টারনেট সেটআপ বক্স কিনবে। কেনার মাধ্যমে তারা তাদের আশেপাশের দোকানে এ ইন্টারনেট বিক্রি/সেবা প্রদান করতে পারবে। ওয়াইফাই রেঞ্জ আনুমানিক ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ মিটার, এ ৫০ মিটার জোনের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রামের গ্রোথসেন্টারগুলোতে অনেক দোকানপাট থাকে। সেখানে সহজেই ইন্টারনেট সেবা এক ব্যক্তি কিনে বা একাধিক ব্যক্তি সমিতি আকারে কিনে সেটা মাল্টিপল ব্যবহার সম্ভব। আইনে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়নি। এছাড়া শহরের বাসভবনে ওয়াইফাই শেয়ারিং করে ইন্টারনেট ব্যবহার সম্ভব। স্টারলিংকে যেহেতু বিল্টইন রাউটার আছে সেহেতু রাউটার হতে রাউটারে আইএসপি সেটআপেও ব্যবহার সম্ভব। পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করব আমাদের মাইক্রোক্রেডিট অথরিটি কিংবা ফাইন্যান্সিয়াল অর্গানাইজেশন কিংবা ব্যাংকের জন্য, যাতে এ স্টারলিংক উদ্যোক্তাদের এ অর্থের সংস্থান হয়। পাশাপাশি যারা নাগরিক সেবার উদ্যোক্তা হবেন, তাদের জন্য স্টারলিংক কীভাবে সহজে নেওয়া যায়- এর জন্যও আমরা ফাইন্যান্সিয়াল প্যাকেজে কাজ করার পরিকল্পনা করছি। আমরা বলছি যে, স্টারলিংকের দাম কিছুটা বেশি। মাসিক খরচ ছয় হাজার এবং চার হাজার নির্ধারণ করা হয়েছে, এটা আমরা স্টারলিংকে কিছুটা নেগোশিয়েশন করে এটা কমিয়েছি। কিন্তু যেহেতু এটা শেয়ার হবে এবং শেয়ার করা যাবে, শেয়ার করার ওপর যেহেতু আমরা বিধিনিষেধ রাখিনি এবং বিক্রি করার ওপরও বিধিনিষেধ রাখিনি। সেজন্য এ ইন্টারনেট দিয়ে ব্যবসা সফল মডেল, এসএমই বা ব্যবসা মডেল তৈরি করা সম্ভব। পাশাপাশি কেউ যদি এ স্টারলিংক ব্যবহার করে তা ইন্টারনেট নিয়ে (মোবিলিটি এবং রোমিং সুবিধা ছাড়া) সেটাকে ফিড করে যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করে সেখানেও আমরা কোনো বাধা রাখিনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের এসএমই কিংবা উদ্যোক্তা বিকাশে সব ধরনের ফ্যাসিলিটি আইন, আইনগত ফ্যাসিলিটেশন রাখা হয়েছে। এর বাইরে আমরা সবাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ফোন লেডি কনসেপ্টে বড় হয়েছি। স্টারলিংকের মাধ্যমে আমাদের মাইক্রোক্রেডিট কিংবা ইএমআই অথবা যেকোনো এমএফআই/এমআরএ পদ্ধতিতে অন্য কোম্পানিগুলো ফাইন্যান্সিয়াল অর্গানাইজেশনগুলো চাইলে ‘ওয়াইফাই লেডি’ হিসেবে নতুন একটা উদ্যোক্তার ধারা সৃষ্টি করতে পারে। তারা চাইলে শুধুমাত্র গ্রামীণ নারীদের একটা বিশেষ ঋণ দিতে পারে যে ঋণের মাধ্যমে তারা স্টারলিংক নিয়ে ইন্টারনেট সেবা বিক্রয় করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভবন ছাড়াও ইনফরমাল কো-ওয়েবিং বিজনেসের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন।
স্টারলিংকের মাধ্যমে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হবে কি এমন প্রশ্নের জবাবে বিশেষ সহকারী তৈয়্যব বলেন, স্টারলিংকের একটি লোকাল গেটওয়ে থাকবে। এর কমার্শিয়াল টেস্ট রান ও গ্রাউন্ড টেস্ট চলমান। এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য স্টারলিংক কোম্পানিকে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়েছে, যার ১০ দিন গত হয়েছে। অতিবাহিত হলেই তাদের লোকাল গেটওয়ে বাধ্যতামূলক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি ডিভাইসের ক্ষেত্রে রেট, ভ্যাট, ট্যাক্স আছে তাই ডিভাইসের বিষয়ে এনওসি নেবে।
চলমান চীন মার্কিন বাণিজ্য দ্বন্দ্বের মধ্যে স্টারলিংকের ব্যবহারে অনুমতি প্রদানে কোনো প্রভাব পড়বে কি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যোগাযোগ প্রযুক্তির বিচারে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়। বাংলাদেশে ৪/৫জি টেকনোলজিতে সর্বাধুনিক নেটওয়ার্ক ও ব্যাকবোন স্থাপনে চীনা প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বিটিসিএল, টেলিটক সংস্থার অধীন চীনা অর্থায়নে ও প্রকৌশলীদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানির ভেন্ডর হিসেবেও অনেক চীনা কোম্পানি কাজ করছে। আমরা চাই, চীন কিংবা মার্কিন ব্যবসায়ীরা যেন স্বাধীনভাবে এখানে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে উন্মুক্তভাবে ব্যবসা করতে পারেন। চীনা কোম্পানি বিডব্লিউ যদি আসতে চায় তারাও একই প্লেসি সুবিধা প্রাপ্ত হবে। উল্লেখ্য, অন্যান্য দেশের কিছু কোম্পানি যেমন Amazon Kuiper, Telesat, Satteloit, এবং Oneweb (UK) আগ্রহী। তারা এখানে ব্যবসা করলে আমরা তাদেরও একই রকম প্লেসি সুবিধা দিতে প্রস্তুত।
আবাসিক গ্রাহকদের জন্য স্টারলিংক এর দাম কি সহনীয় সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিশেষ সহকারী আরও বলেন, একটা ভবনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এমন অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট, কনডোমিনিয়াম ও ফ্ল্যাট থাকে। তারা বেশ কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট যারা পাশাপাশি থাকে তারা মিলে চারটা বা পাঁচটা অ্যাপার্টমেন্ট বা কয়েকটা তলা মিলে এ সার্ভিস ব্যবহার করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে রেঞ্জ সর্বোচ্চ ২০ মিটার করতে পারবেন। সবকিছু মিলিয়ে উদ্যোক্তাদের জন্য এবং কনজিউমারদের জন্য এককালীন দামটা বেশি হলেও সেটআপ কস্টটা বেশি হলেও আমার মনে হয় এটা যখন ডিস্ট্রিবিউটেড হয়ে যাবে অর্থাৎ সমবায় ভিত্তিতে হবে। তখন এটার আর খুব বেশি অনুভূত হবে না।
রিজিওনাল প্রাইস বিবেচনায় স্টারলিংকের ব্যয় কী বাংলাদেশে বেশি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিজিওনাল যে প্রাইস আমরা অ্যানালাইসিস করেছি সেখানে দেখেছি যে, রিজিওনাল প্রাইসের তুলনায় বাংলাদেশে স্টারলিংকের দাম সবচেয়ে কম। এমনকি শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের চেয়েও কম। সো আমরা এটা মানুষের সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রয়েছে। যেহেতু বিষয়টা শেয়ার হবে, একক ব্যক্তি যিনি কিনবেন, যিনি ব্যয় নির্বাহ করবেন তার জন্য দাম বেশি হলেও শেয়ারিং এ কোনো সীমা না থাকায় একাধিক শেয়ারিং এ দাম কমে আসবে।
সরকারি কোম্পানির স্বার্থ কীভাবে রাখা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে বিশেষ সহকারী বলেন, দুইভাবে সরকারি কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রথমত সাবমেরিন কেবল কোম্পানির মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত স্যাটেলাইট কোম্পানির মাধ্যমে।
এমআইএইচ/আরআইএস