সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাই শহরে বসেছিল দু সপ্তাহের আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন সম্মেলন ডব্লিউসিআইটি। এ সম্মেলনে প্রথম দিকে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের ওপর অপচেষ্টাই সরব হয়ে উঠে।
এ সম্মেলনে ভারত শুরু থেকেই কঠোর নিয়ন্ত্রণে পক্ষে অবস্থান করে। নীতিনির্ধারকদের কাছেও এ ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের পক্ষে খুব বেশি জোরালো যুক্তি নেই। তবে তথ্য সন্ত্রাস (সাইবার ক্রাইম) নিয়ে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই শঙ্কার মধ্যে আছে।
এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ খাতে প্রতিবন্ধকতাগুলো শিথিল করতে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট আসে। এতে আন্তঃসরকারের সিদ্ধান্তে ভিত্তিতে এ সেবাখাতের মানোন্নয়ন করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা হয়।
এদিকে আইটিইউ নিয়ন্ত্রিত ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম রেগুলেশনস (আইটিআর) ১৯৮৮ সালে সবশেষ ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের ওপর আইনি পাশ করে। এটা এখনও বহাল আছে। আর এটি আগামী ৩ বছরের জন্য মেনে চলার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় দুবাইয়ের এ ইন্টারনেট সম্মেলনে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং তথ্যের অপব্যবহার প্রতিরোধে প্রতিটি দেশের সরকার এ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার অব্যাহত রাখা হলো। তাই এবারের সম্মেলনে ইন্টারনেট বিশ্বের অবাধ দুয়ারের সম্ভাবনা আগামী ৩ বছরের জন্য বলবৎই থাকল।
ফলে ইন্টারনেট বিশ্বের সমাজ নিয়ে টানাপোড়েন আর রাষ্ট্রীয় তথ্য ঝুঁকির নিয়ন্ত্রণের কলকাঠি প্রতিটি দেশের সরকারের কব্জাতেই থেকে গেল। এ সম্মেলনের শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয় ইউএন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ছাড়াও অন্য সব দেশগুলো এবারের আইনে সম্মত হতে চাইছিল না। কিন্তু শেষে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রচলিত আইনকেই পাশ করা হয়।
ইন্টারনেটভিত্তিক গণতন্ত্র প্রকল্পের মুখপাত্র আনজা কোভাকস জানান, এখনও ভারত ইন্টারনেট নীতিতে তার মতামত প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা রাখে। তাই চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুতে ভারত আপত্তি তুলতে পারে। এ মুহূর্তে প্রায় দেশই ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম রেজ্যুলেশন (আইটিআর) মেনে চলছে।
এমনকি দুবাইয়ের এবারের সম্মেলনের আগেও ইন্টারনেট স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা-সমালোজনার ঝড় ওঠে। এদিকে চীন এবং রাশিয়ার মতো দেশ আইটিইউয়ের মধ্যস্থতার মাধ্যমে ইন্টারনেট স্বাধীনতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে অবস্থান নেয়। ইউনাইটেড নেশন ডেভেলপমেন্ট গ্রুপকেও এ বিষয়ে তদবির কথা হয়। তবে এ বিরোধীতা শেষ পর্যন্ত আলোচনায় টিকে থাকতে পারেনি।
আইপি ঠিকানায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং শর্তভিত্তিক বিপণণ কৌশলকে সর্বোচ্চ সম্মতির সাপেক্ষে এ সম্মেলনে ছাড় দেওয়া হয়। ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম (ডট) সূত্র এ তথ্য দিয়েছে।
এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বেশ কিছু দেশ ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে আইটিইউয়ের ক্ষমতা প্রয়োগে জবাবাদিহিতা এবং আইন প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দাবি তোলে। এ ছাড়াও অনলাইন কনটেন্ট প্রচার ও নিয়ন্ত্রণে ‘অনলাইন কোড অব কনডাক্ট’ মেনে চলার প্রতি সবগুলো দেশের প্রতি পরামর্শ দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে গুগল মোবাইলভিত্তিক প্রচারণার পক্ষে ইন্টারনেটের ব্যবহারকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রথমশ্রেণীর অনলাইন প্রকাশনা সংস্থা যেমন নিউ ইয়র্ক টাইমস সতর্কতার বিষয়টি আমলে নিতে বলেছে। একে ‘দ্য ইন্টারনেট কোল্ড ওয়্যার’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
এদিকে বেশিরভাগ রাষ্ট্রই অনলাইন স্বাধীনতার বিষয়ে চুক্তি সই এবং নিয়ন্ত্রণের একক অধিকার ইউএনভিত্তিক না হয়ে রাষ্ট্রভিত্তিক হওয়া উচিত বলে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রাখেন।
এ প্রসঙ্গে সম্মেলনে অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষক মিলটন ম্যুয়েলার তথ্য এবং যোগাযোগপ্রযুক্তির অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক তথ্য বিষয়ে গবেষণা তথ্য তুলে ধরে এ নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেন। এ ছাড়াও হার্ভার ল স্কুলের অধ্যাপক জ্যাক গোল্ডস্মিথও এ বিষয়ে ব্লগে লেখেন।
সামাজিক প্রতিনিধি হিসেবে এ সম্মেলনে ব্যাঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ল স্কুলের অধ্যাপক চিন্ময় অরুণ বলেন, ভারত নিজের প্রয়োজনানুসারেই ইন্টারনেট নীতি নিয়ে কাজ করবে। এ জন্য চুক্তি কোনো টেকসই সমাধান হতে পারে না। এ ছাড়া তথ্য অবাধ করতে টেলিযোগাযোগ খাতকে আরও সুসম্প্রসারিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ আইনের আওতায় এবং ব্যক্তি তথ্যের প্রতি সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়ে আইটিইউয়ের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে সবগুলো সদস্য দেশগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ইন্টারনেট বিশ্বের ভবিষ্যৎ ভাগ নির্ধারণের মতবিনিময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে দু সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনে ইন্টারনেট বিশ্বের মুক্ত চর্চায় নতুন করে তেমন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। এতে প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ সরকারের হাতেই থাকছে ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ তা নিশ্চিত হয়েছে।
এ সম্মেণনে অংশ নেওয়া ১৯৩টি দেশের কোনো সরকারই ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি হয়নি। বরং কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বারবার আওয়াজ উঠেছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অপপ্রচারর ঠেকাতে ইন্টারনেটে ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এমন যুক্তির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন অংশ নেওয়া দেশগুলোর সরকারি প্রতিনিধিরা।
যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এখন সরকারি নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রতিটি দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনার ওপর কব্জা প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে মুক্তমত চর্চার অবাধ ক্ষেত্রটি গণবিমুখ হয়ে পড়তে যাচ্ছিল। এতটা নিয়ন্ত্রণ আর আইনি বিধিনিষেধ থাকলে সাধারণ মানুষের জনমত প্রকাশে এ জনপ্রিয় মাধ্যমটি কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
অথচ ইন্টারনেট প্রতিটি দেশের সরকারকে আরও বেশি জনপ্রিয় আর গণবান্ধব করে তুলতে পারে। এ ধারণা যেন সরকারগুলো মানতেই নারাজ। এ নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি। এমনই মন্তব্য করেছেন ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞেরা।
এরই মধ্যে দুসপ্তাহের এ নীতিনির্ধারনী সম্মেলন শেষে মূল সিদ্ধান্ত সুস্পষ্ট হয়েছে। প্রচলিত আইনের তেমন কোনো পরিবর্তনই আসেনি না এ সম্মেলনে। তাই ইন্টারনেপ্রেমীদের জন্য আপাতত খুব বেশি চাপ আসছে না।
প্রসঙ্গত, আর্টিকেল ৩৪ এর ধারা মতে, আইটিইউয়ের প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র জনস্বার্থে ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আইনি অধিকার প্রয়োগে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। রাষ্ট্রের সুব্যবস্থা, আইন এবং গণতন্ত্র ঝুঁকিপূর্ণ হয় এমন আশঙ্কায় কোনো রাষ্ট্রই এ নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে পারবে না। অর্থাৎ ইন্টারনেটে মুক্তচর্চার কারণে কোনো সহিংসতা ঘটলে এর দায় ওই দেশের সরকারকেই নিতে হবে। এমন কথাই দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন আইটিইয়ের মহাসচিব হামাদুন টুর।
ফলে ইন্টারনেটের অবাধ ভবিষ্যৎ আবারও সরকারি নিয়ন্ত্রণের জালের জরিয়েছে। এখানে জনমত, বৈশ্বিক যোগাযোগ এবং সাধারণ মানুষের মত প্রতিষ্ঠায় সব ধরনের সুযোগকেই অমিমাংসিত রেখেছে আইটিইউ।
এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড টেকনোলজির নীতিনির্ধারক ইমা ল্যানসো জানান, ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনাকে টেলিযোগাযোগের মতো করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে। এতে অবাধ তথ্যপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে। প্রাইভেসির দোহাই দিয়ে ইন্টারনেটে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই মুক্তচর্চা এবং তথ্য স্বাধীনতার পক্ষে যায় না। এমনটাই বললেন দুবাই সম্মেলনে অংশ নেওয়া অনলাইন বিশেষজ্ঞেরা।
বাংলাদেশ সময় ১৫৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১২