কক্সবাজার থেকে: মাহমুদ হাসান সানি। দায়িত্ব পেয়েছেন ওডেস্ক বাংলাদেশ অ্যাম্বাসেডর হিসেবে।
বয়সে একেবারেই তরুণ। তবে বুদ্ধিদীপ্তি আর বাকপটু সানি এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ওডেস্কের সক্রিয় মুখপাত্র হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। ফলে দেশে ওডেস্কের কার্যক্রম সুসম্প্রসারিত এবং বাজার উন্নয়নে এ তরুণ অনেক ভাবনার কথাই বাংলানিউজকে জানায়। আগামী ২০২০ সালেই মধ্যেই বিশ্বের অর্ধেক প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিংয়ের নিজেদেও কাজ করবে। ফলে অফিসকেন্দ্রিক স্থায়ী কর্মীর সংখ্যাও কমে আসবে।
বাংলাদেশ এখন ওডেস্কে কাজের তালিকায় শীর্ষ তিনে আছে। প্রথম অবস্থানে ফিলিপাইন। আর দ্বিতীয়তে ভারত। কিন্তু প্রবৃদ্ধির হিসাবে সবচেয়ে কম সময়ে বাংলাদেশই সফলতার শীর্ষে। তবে এ বাজারে গুণগত মান ধরে রাখাটা চ্যালেঞ্জ। এ জন্য সুদক্ষ কর্মী বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই।
অধিকাংশ আগ্রহীর মধ্যে ওডেস্ক আর আউটসোর্সিং নিয়ে ভুল ধারণা আছে। এখানে যে কেউ এসেই কোনো দক্ষতা আর যোগ্যতা ছাড়া অর্থ উর্পাজন করতে পারে না। অর্থাৎ এটি সুনির্দিষ্ট আয়ের কোনো মডেল জব নয়। আবার চাকরি করলে কত বেতন হতো আর এটা করে কতটা আয় করা যাবে এসব হচ্ছে প্রাথমিক প্রশ্ন। কিন্তু আউটসোর্সিং আসলে কি? কিভাবে এখানে আরও দক্ষ কর্মী হওয়া যায় এসব বিষয়ে শুরুতেই কেউ জানতে চায় না।
কাজ ছাড়া কোনো অর্থ কি উপার্জন করা যায়। নিশ্চয়ই না। তাহলে তো কারও কাজ করার দরকার হতো না। যে কাজে যত বেশি পারশ্রমিক সে কাজে তত বেশি যোগ্যতা প্রদর্শন করতে হবে। এটাই নিয়ম।
আউটসোর্সিং নিয়ে সানির হাতেখড়ি ২০০৮ সালে। তখন রেন্ট এ কোডারে কাজ করত সানি। কিন্তু ২০১০ সালে ওডেস্কে কাজ শুরু করে দ্রুতই বদলে যেতে থাকে সানির লাইফস্টাইল। একেবারে প্রথম ৫ ডলারের কাজেই ১৮ ডলার পেয়ে যান এ উদ্যমী আউটসোর্স কর্মী।
এরপর একে একে ১০০ ডলারের গন্ডি পেরিয়ে যান। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধুই এগিয়ে চলা। ঘন্টাভিত্তিক এ কাজের জগতটা এ সময়ের তরুণদের কাছে দারুণ পচ্ছন্দের। ছকে বাধা নয়টা-পাঁচটার চাকরিতে অনেকেই এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তাই আউটসোর্সিং পেশায় আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ছে।
ওডেস্কের এ দেশি অ্যাম্বাসেডর সুদীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার কথা ভাবেন। আউটসোর্সিয়ের ফলে রাজধানীমুখী চাপটা কমবে। ফলে আঞ্চলিক অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে। একটি ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ আর ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা থাকলেই যেকোনো স্থানই অফিস হয়ে উঠতে পারে। এ সুযোগকে পূর্ণাঙ্গভাবে কাজে লাগাতে না পারলে আউটসোর্সিয়ের আসল মজাটা উপভোগ করা যাবে না।
অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬ হাজার খ্রীষ্ট ধর্মালয়ে সানির তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হবে। আর প্রতিটি ভেন্ডর মেশিনেই লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এটা সানির জন্য বটেই, দেশের জন্যও গর্বের।
শুধু নিজের উন্নতির কথা ভাবলে খুব বেশি কিছু করা যায় না। এজন্য প্রথমে সমাজ তথা দেশের উন্নতির কথা ভাবলে বড় কোনো কাজের সূচনা হয়।
শুভ্র বণিক
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এআইইউবির ট্রিপল ই-শিক্ষাথী। চট্টগ্রামের আউটসোর্সিং কর্মশালা সেরে এসেছেন কক্সবাজারে। ওডেস্কের নতুন কর্মী। এরই মধ্যে ওডেস্কে নিবন্ধন করে টুকটাক কাজও করছেন। চোখেমুখে কিছু একটা করে দেখানোর প্রত্যয়। এখন কাজ করছেন শিক্ষানবিশ হয়ে। ওডেস্ক কনট্রাক্টরদের সাব-কনট্যাক্ট নিয়ে কাজ করছে এ তরুণ। আগে কাজটা ভালোভাবে রপ্ত করতে চান। এরপর কর্মযজ্ঞ। এর কারণ জানতে চাইলে বলেন, দক্ষতা নিয়ে কাজ শুরু করলে আয়টা শুরু থেকেই বাড়িয়ে নেওয়া যায়।
ফরহাদ মোল্লা
বয়স ২২। মার্কেটিংয়ে বিবিএ করেছেন। ২০১১ সালের অক্টোবরে নিবন্ধন করে এখন ওডেস্ক ভক্ত। বললেন দু ধাপে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বা এসইও কাজ করা যায়। অন-পেজ আর অফ-পেজ। বাংলাদেশের ওডেস্ক-কর্মীদের মধ্যে এসইও নিয়ে আগ্রটা বেশি।
এ কাজে পারিশ্রমিক এখন আগের তুলনায় কমে গেছে। এ কাজে খুব বেশি দক্ষতা আর মেধার প্রয়োজন না। আগের এ কাজের বিড যেখানে ন্যূনতম ৭ ডলারে হত সেখানে ফিলিপাইনদেও কারণে এ কাজে বাংলাদেশিরা এখন মাত্র ১ ডলার আয় করছে। তাই অন্য কাজের প্রতি দক্ষতা এবং যোগ্যতা বাড়াতে দেশি ওডেস্ক-কর্মীদের আগের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হবে।
আসিফ নেওয়াজ
বয়স সবে ২৩। পড়ছেন আতিশ দিপঙ্কর ইউনিভার্সিটিতে। বিষয় সিএসই। ওডেস্ক থেকে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ আয় করেছেন ১৬ ডলার। আর গড়ে আয় করেছেন ১০ ডলার। একেবারে নতুন কর্মী তবে সচেষ্ট আগ্রহী হলে ১৫ দিনের মধ্যেই ওডেস্কে কাজ শুরু করে অল্প কিছু আয়ও করতে পারবেন। তবে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ছাড়া শুধু অর্থ আয়ের দিকে ঝুঁকলে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাবে না শেষ পর্যন্ত।
এ ছাড়া লিঙ্ক বিল্ডিং নিয়ে সাধারণভাবে কাজ করা যায়। তবে প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইন এবং অনলাইন মার্কেট রিসার্চে কাজ করতে পারলে আয়টা বাড়িয়ে নেওয়া যাবে।
এদিকে ওডেস্কের কন্ট্রাকটর কমিউকেশনের মুখপাত্র মনিকা চুয়া বাংলানিউজকে বলেন, শুধু কাজ জানলে আর কাজের খবর রাখলেই আউটসোর্সিংয়ে ভালো করার যায় তা নয়। আউটসোর্সিং মার্কেটপ্লেসে নিজের দক্ষতা আর যোগ্যতার সঙ্গে কাজের সম্বনয় করাটাও একটি বিশেষ গুণ।
বাংলাদেশের উদীয়মান এ খাতে তরুণদের এ অংশে একটা ঘাটতি দেখা যায়। এখানে তরুণেরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। নিজে থেকে জানার আগ্রহরা অনেকেরই একটু কম। এ জন্য শুধু সার্চ ইঞ্চিন অপটিমাইজেশন নিয়েই বেশি কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে।
২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বর্তমান আউটসোর্সিং বাজারে দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধি করবে এ বিশাল বাজার পেতে অনেক আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশকে আমলে নিয়েছে।
এ সম্ভাবনাকে শুধু কাগজে-কলমে আর সমীকরণে না নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আউটসোর্সিং পেমেন্ট পদ্ধতি উন্মুক্ত আর সহজ হলে বাংলাদেশ দ্রুতই এ খাতে আরও চমক দেখাবে। এমন প্রত্যাশাই রেখে গেছেন বাংলাদেশ সফরে আসা ওডেস্কের মুখপাত্র ম্যাট কুপার।
এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোন এবং অ্যানড্রইয়ের অ্যাপস ও আইওএস এর ব্যাপক চাহিদা। বাংলাদেশের খুদে প্রযুক্তিবিদেরা এ খাতে নিজেদের আরও দক্ষ করে তুলতে ওডেস্ক তাদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এতে আয় এবং আউটসোর্সিং তালিকায় বাংলাদেশ আরও উচ্চতায় চলে আসবে।
শুধু প্রয়োজন কাজের ধরন বুঝে কাজের অর্ডার নেওয়া। আর সঠিক সময়ে দক্ষতার সঙ্গে পার্টির কাজ সুসম্পন্ন করা। গত ৩ বছরে বাংলাদেশ আউটসোর্সিংয়ে ভালোই দক্ষতা অর্জন করেছে। আর ভবিষ্যতেও এ খাত বাংলাদেশের জন্য বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করছে।
আর দক্ষতা অর্জনে বাংলাদেশের আউটসোর্সিং কন্ট্রাক্টররা ওডেস্কের কর্মীদের সঙ্গে স্কাইপি চ্যাটের সহযোগিতা নিতে পারে। আর সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং (এসইএম) দারুণ কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। এ খাতে বাংলাদেশের তরুণদের আয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
এক্ষেত্রে কমপিউটার সায়েন্সের তুলনায় অভিজ্ঞ এবং উদ্ভাবনী (আইডিয়া) জ্ঞান আছে এমন কর্মীদের বাজার চাহিদা এবং কদর দুটোই বেশি। বাংলাদেশে এ ধরনের আউটসোর্সিং কন্ট্রাকটরদের সংখ্যা অনেক বেশি। আর দক্ষতা আর আগ্রহের কমতি নেই। এ শক্তিকে কাজে পরিণত করতে পারলে একটা বিপ্লবও হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়াও ওয়েব রিসার্চ (ডব্লিউআর) নিয়েও কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বিশ্বের কোটি কোটি সাইটের জন্য গবেষণা এবং উন্নয়নে কাজ করতে পারলে ভালো কাজের সুযোগ আছে। এমনকি ওয়েবসাইটে পিআর (পাবলিক রিলেশন) করেও এখন ভালোই আয় করছে বাংলাদেশিরা।
এ মুহূর্তে ওয়েব ডেলেপমন্টে, রাইটিং অ্যান্ড ট্যানসেলেশন, কাস্টোমার সার্ভিস, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সাপোর্ট, নেটওয়ার্কিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া এবং বিজনেস সার্ভিসেস এ কয়েকটি বিভাগে আউটসোর্সিং কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে ওডেস্ক।
বাংলানিউজকে দেওয়া ওডেস্ক বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর মাহমুদ হাসান সানির সাক্ষাৎকারের এটি প্রথম কিস্তি। পরের কিস্তিগুলোতে আউটসোর্সিং অভিজ্ঞদের কাজের গাইডলাইন, বিকল্প কর্মসংস্থান এবং আয়ের কয়েকটি ইস্যু নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তুলে ধরা হবে। এ নিয়ে জানতে নিয়মিত চোখ রাখুন বাংলানিউজে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৩
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর