শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের তরুণদের কাছে এখন গতানুগতিক রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা মার খেয়ে গেছে। এ প্রজন্ম কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে ঠিকই।
তারা ফেসবুক ব্যবহার করছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে ফেসবুকে তার পড়া লিঙ্কটি শেয়ার করে দিচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে। তারা ঘরে বসে ব্লগিং করে ঠিকই। ব্লগিংয়ে নিজের ভাষায় কথা বলতে শিখেছে। জ্ঞান চর্চা করেছে।
তারা নিত্যনতুন মডেলের মোবাইল ব্যবহার করছে কিন্তু তারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তুলে নিমিষেই অনলাইনে আপলোড করতে পারে। স্মার্টফোন দিয়ে ব্লগিং, ভিডিও শুট, ভিডিও আপলোডসহ সবই সম্ভব।
তাদের এসব প্রযুক্তির কাছে মার খেয়ে গেছে রাজনীতির চাতুর্যের ভাষা। এ আন্দোলন তথ্যপ্রযুক্তির শক্তিতে বলিয়ান। এ প্রজন্ম স্মার্ট। তারা মুহূর্তেই নিজের কথা ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল জানে। তাদের কেউ সহজেই বিভ্রান্ত করতে পারে না। তারা যে রাজনীতিবিদদের ভোঁতা ভাষা বোঝে তা সরাসরি বলতে কোনো কারপণ্যই নেই তাদের ভাষায়।
উইকিপিডিয়াতে শাহবাগ
শুরুতেই বাংলাদেশের তরুণেরা আন্তর্জাতিক তথ্যকোষ উইকিপিডিয়ায় শাহবাগ প্রোটেস্ট (http://en.wikipedia.org/wiki/2013_Shahbag_Protest) শিরোনামে এ আন্দোলনের সব তথ্য আপলোড করে দিয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে অনলাইনে শাহবাগ প্রোটেস্ট লিখে সার্চ দিলেই উইকিপিডিয়ার এ তথ্যকোষ থেকে পেয়ে যাবেন সব ধরনের তথ্য।
শিল্পীদের অনলাইন ভাষা
এ প্রজন্ম মাঠে নামার পরপরই ওপার বাংলার গায়ক কবির সুমন গান লিখেছেন। সুর করে তার নিজের ওয়েবসাইটেও আপ করে দেন। অনুপ্রেরণা তখন থেকেই শুরু। এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে চমক হাসান প্রতিবাদ করে।
শাহবাগের তরুণদের উজ্জীবিত করে গান গেয়ে অনলাইনে আপ করে দেন। শিল্পীদের ভাষাতেই জবাব আসতে থাকে। পরে অর্থহীনের সুমন, হায়দার হোসেন ছাড়াও অনেকেই নতুন গান লিখে সুর করে আপলোড করতে থাকেন। যারা শুনছেন তারা শেয়ার করছেন। মনে রাখতে হবে, মাত্র ১৩ দিনের আন্দোলনে কতকিছু। এ পর্যন্ত ২০টিরও বেশি গান অনলাইনে আপলোড করা হয়েছে।
অনলাইনের চরমপত্র
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এমআর আক্তার মুকুলের চরমপত্র তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ২০১৩ সালে চরমপত্র আরও একবার ফিরে এল। এ পর্যন্ত ৪টি পর্ব প্রকাশ হয়েছে চরমপত্রের। এগুলো অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। এ নিয়ে কমতি এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। সামাজিক গণমাধ্যমের (https://www.facebook.com/photo.php?v=10151237183171736) এ লিঙ্কে প্রজন্মের চরমপত্র পাওয়া যাবে।
গ্রিনিজবুকে শাহবাগ
ফেসবুকের একটি ফ্যানপেজ ‘মজা লস’। তারা গ্রিনিজবুকের ফ্যান পেজে গিয়ে অনুরোধ জানায় শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের ঘটনা ঐতিহাসিক। প্রসঙ্গত, লেবাননে একসঙ্গে ২৯৫৯টি মোমবাতি জ্বলে উঠেছিল এটিই এ পর্যন্ত গ্রিনিজবুকে ঠাঁই পেয়ে বসে আছে। অথচ শাহবাগে একসঙ্গে মোমবাতি জ্বলে উঠেছিল তার চেয়েও বহুগুণ বেশি।
এ নিয়েই কাজ করেছে ‘মজা লস’ পেজের সদস্যরা। তারা তখন তাদের ৭৭ হাজার সদস্যদের অনুরোধ জানান গ্রিনিজবুকের পেজে গিয়ে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের ছবি শেয়ার করার। সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে ৮ ঘণ্টায় ২ হাজার হাজার বার ছবি শেয়ার করে গ্রিনিজবুকের পেজে।
এরপর গ্রিনিজবুক কর্তৃপক্ষ অনেকটা বাধ্য হয়ে ঘোষণা দেয়, যদি অফিসিয়ালি তাদের এ বিষয়টি জানানো হয়, তবে এ নিয়ে তারা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ফেসবুকের (https://www.facebook.com/photo.php?v=10151405228268632) এ লিঙ্কে তথ্য পাওয়া যাবে।
ফেসবুকে জবাব
বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীরা নানান রকম মন্তব্য করছেন। কেউ বলছেন, শাহবাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দীর্ঘদিন বন্ধ করে রাখা ঠিক না। কেউ বলছেন, এসব আন্দোলনের সঙ্গে আরও পয়েন্ট যুক্ত করা উচিত।
অনলাইন স্টাইলেই তারা জবাব তৈরি করেছেন। শাহবাগ রাস্তা বন্ধ নিয়ে তাদের ফেসবুক জবাব হলো, ৪২ বছরের রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। সেজন্য শাহবাগের রাস্তা সাময়িক বন্ধের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
আবার অন্য সব ইস্যু যুক্ত করা প্রসঙ্গে ফেসবুক জবাব হলো, আমরা অঙ্ক পরীক্ষার দিন অঙ্ক পরীক্ষা দেই, বাংলা পরীক্ষার দিন বাংলা পরীক্ষা আর ইতিহাসের দিন ইতিহাস পরীক্ষা দেই। ইতিহাস পরীক্ষার দিন আমরা অর্থনীতির পরীক্ষা দেই না। যখন অর্থনীতির পরীক্ষা আসবে তখন আমরা অর্থনীতির পরীক্ষাই দেব।
তাদের এসব ফেসবুক জবাব এখন টিভির টক শো ছাড়াও বিভিন্ন মিডিয়াতেও দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। চোখে আঙুল দিয়ে চেতনার জায়গায় নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে এ প্রজন্ম।
এভাবেই অনলাইনে নিজের ভাষায় নিজেদের স্টাইলে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে শাহবাগের জাগ্রত প্রজন্ম চত্বর। এ প্রসঙ্গে ড. ইমতিয়াজ উদ্দিনের একটি লেখার কয়েকটি লাইন এমন তিনি সমকালে প্রকাশিত একটি লেখায় উল্লেখ করেন, ‘ ... এ যুগের প্রতিটি ব্যক্তি খবর তৈরি করতে পারে এবং ছড়িয়েও দিতে পারে। তারা নিজেরাই এক একটি গণমাধ্যম। ব্যক্তি যখন গণমাধ্যম হয়ে ওঠে, তার শক্তি হয় অসীম। কারও ওপর তারা নির্ভর করে না। কেউ বিকৃত খবর বা তথ্য দিলে সেটা তারা সহজে ধরে ফেলে এবং অন্যকে জানিয়ে দেয়। দিনে দিনে এ প্রবণতা বাড়ছে। ’
পরিশেষে বলতে চাই, এ প্রজন্ম নিজের ভাষায় কথা বলতে শিখে গেছে। সে ভাষা ছড়িয়ে দিতেও শিখে গেছে। তাদের শক্তির কাছে এখন সেঁকেলে রাজনীতির ভাবনার অস্ত্রটি এখন অচল।
এ জাগরণের কোনো এপাশ-ওপাশ হিসাব-কিতাব করে আমাদের রাজনীতিবিদদের লাভ নেই। কারণ আন্দোলনের এ নতুন প্রেক্ষাপট তাদের কাছে অচেনা, অজানা। তথ্যপ্রযুক্তির শক্তি আটকে রাখা যায় না।
তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) দিয়ে মানুষ দেশের গন্ডি পেরিয়ে যেতে শিখেছে। এ জন্য রাজনীতির নতুন ভাষা এখন রাজনীতিবিদদেরই অনুসন্ধান করতে হবে। মানুষের মনের কথা, নতুন প্রজন্মের হৃদয়ের স্পন্দনের দিকে রাজনীতিকে এখন তাকাতেই হবে।
কারণ যৌবন যখন মাঠে নামে তখন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মুশকিল। তাদের সঙ্গেই, তাদের ভাষাতেই কথা না বলা পর্যন্ত তারা মাঠ ছাড়ে না। কারণ যৌবনের শক্তি পেছনে যাওয়ার জন্য নয়।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই প্রজন্মের এ নব্য প্রতিবাদী ভাষা রাজনীতিবিদদের জন্য ভবিষ্যতের অনুকরণযোগ্য পাথেয় হবে। এ যুুক্তির সঙ্গে অনলাইনে একাত্ব প্রকাশ করেছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও।
বাংলাদেশ সময় ২১৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর