ঢাকা: নিম্নমানের চায়না মোবাইল ফোন সেট সিম্ফনি ব্যান্ড নামে বিক্রি করে ব্যাপক গ্রাহক প্রতারণা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সিম্ফনি বাজারজাতকারী এসবি টেল এন্টারপ্রাইজ চীন থেকে অপরচিতি ব্র্যান্ডের কমদামি সেট এসে সিম্ফনি ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি করছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাজারে সিম্ফনি নামে যে সেটগুলো ছাড়া হচ্ছে তার অধিকাংশই সস্তা দরে চীন থেকে কিনে আনা।
কমদামে সব ধরনের আধুনিক সুবিধার কথা প্রচার করে সিম্ফনি প্রলুব্ধ করছে গ্রাহকদের। কিন্তু কিনেই হতাশ হতে হচ্ছে তাদের।
বাংলানিউজের কাছেও এ ব্যপারে অভিযোগ করেছেন অনেক গ্রাহক। তারা এমন প্রতারণা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সিম্ফনির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি তুলেছেন কেউ কেউ।
বিষয়টি টেলিফোন যোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)’র দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ ধরনের গ্রাহক প্রতারণা উদ্বিগ্ন বিটিআরটি বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের নিম্নমানের সেট কেনা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
বিজ্ঞাপনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে ব্যাপক হারে নকল ও নিম্নমানের মোবাইল সেট আসছে। আমদানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ব্যবসায়ীরা এসব মোবাইল ফোনসেট আমদানি করছেন। এ বিষয়ে ক্রেতা ও আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিটিআরসি’র এই উদ্বেগ সিম্ফনি সেটের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য বলেই মত অনেক গ্রাহকের। তাদের মতে, সিম্ফনি সেট কেনা মানে পুরো টাকা জলে ভাসিয়ে দেয়া।
সহজ সরল গ্রাহকদের ঠকাচ্ছে এসবি টেল, এমনটাই মত দেন একজন গ্রাহক।
রিফাত হোসেন নামে এক গ্রাহকের মতে, নিম্নমানের সেট বিক্রি করে সিম্ফনি বাংলাদেশের তরুণদের মন ভেঙ্গে দিচ্ছে। তারা অনেক আশা নিয়ে জমানো অর্থ ব্যয় করে একটি সেট কেনে কিন্তু ফোনগুলো থেকে তারা আশানুরূপ সার্ভিস পায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র আবদুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, আমি সিম্ফনির এক্সপোর ডব্লিউ-১০০ সেটটি ১৯ হাজার ৯৯০ টাকা দিয়ে কিনি। কিনে প্রথম একদিন ভালোভাবে চলে। পরেরদিন থেকে দেখি টাচ স্ক্রিন ঠিকভাবে কাজ করেনা আর বারবার হ্যাং হয়। মেমোরি কার্ড রাখলে হ্যাং হয়ে থাকে আর মেমোরি কার্ড খুললে চলে। যা ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা।
ওয়ারেন্টি প্রতারণা
সিম্ফনি ব্র্যান্ড কিনে গ্রাহক সবচেয়ে বড় প্রতারণায় পড়ছেন এর ওয়ারেন্টি নিয়ে। কেনার সময় প্রতিটি সেটেই দেওয়া হচ্ছে এক বছরের ওয়ারেন্টি। কিন্তু সিম্ফনি কিনে ওয়ারেন্টি সময়ের মধ্যে বিক্রেয়োত্তর সেবা পাচ্ছেন না বলেই অভিযোগ গ্রাহকদের। ওয়ারেন্টি থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
২০ হাজার টাকায় সিম্ফনি কিনে একদিনের মধ্যে ঝামেলায় পড়ে যাওয়া আবদুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, “ফোন সেটটি আমি অ্যালিফ্যান্ট রোডের আরবিএস ইনফোসিস থেকে কিনি। তাদের কাছে গেলে তারা আমাকে পুরানা পল্টনের বাইতুল ভিউ ট্রেড অ্যাসোসিয়েটস এ পাঠায়। সেখান থেকে নিকেতনের সার্ভিসিং সেন্টারে পাঠায়। এভাবে বারবার যেতে আমার অনেক টাকা ও সময় ব্যয় হয় কিন্ত ফল পাইনা।
রহিম তার অভিযোগে আরও জানান, সার্ভিসিং সেন্টার তার সেটটি ১০ দিন রেখে জানায়, স্ক্রিনে সামান্য সমস্যা আছে নতুন একটি আমদানি করতে সময় লাগবে। এরপরও দুই মাস কেটে গেছে কিন্তু কোন সার্ভিস পাননি তিনি।
রহিম বলেন, আমার এই পুরো ২০ হাজার টাকাই জলে গেলো। আমি এ ব্যপারে সিম্ফনির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলে মামলা করার প্রস্ততি নিচ্ছি।
এসবি টেল সূত্র জানায়, এক হাজার ৯৯ টাকা থেকে শুরু করে ১৯ হাজার ৯৯০ টাকা দামের সেট বিক্রি করছে তারা। কিন্ত নিম্নমানের কারনে দামি সেটগুলো কম চলে। আর কমদামী সেটগুলো কিছুটা চললেও তা মানসম্পন্ন সেট হিসেবে বিবেচিত হয়না।
মানসম্পন্ন দোকান সিম্ফনি বিক্রি করে না
বসুন্ধরা সিটির একজন মোবাইল ফোন সেট ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, অনেকেই দাম ও ফিচারের সমন্বয় করতে গিয়ে নিম্নমানের চায়না মোবাইল সিম্ফনি কিনছে। পরে দেখা যায় ঐ ফোনের অনেক কিছুই ঠিকমত চলছে না। তাই সবার উচিৎ ভালভাবে দেখে শুনে ভালো ব্র্যান্ডের সেট কেনা।
তিনি বলেন, আমরা আগে সিম্ফনি বিক্রি করলেও কাস্টমারের নানা রকম অভিযোগ ও বিক্রিয়োত্তর সেবা না থাকায় এখন এসব নিম্নমানের সেট রাখিনা। সিম্ফনির টার্গেট মূলত নিম্নবিত্তরা। বস্তি ও গ্রামের বাসিন্দাদের টার্গেট করে প্রতারণা করছে সিম্ফনি।
আরও কয়েকজন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন সিম্ফনির ডি ৪২, ডি ৪৪, ডি ৬৫, ডি ৭৫, সি ১০৫, ইএক্স ৭০, ইএক্স ৮২, এস ৯০, এস ৯৭, টি ৫৫, টি ৬০ আই, এক্স ৯৫ এবং এক্স ১০০, এক্স ১১০ মডেলের সেটগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ আসে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, অল্প টাকায় সিম্ফনি সব সুবিধা দেওয়ার নামে প্রতারণা করে যাচ্ছে। সিম্ফনির ফোন সেটগুলোর হার্ডওয়্যার কিংবা সফটওয়্যারের কোন সমস্যা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেরামতের কোন উপায় থাকে না। আর কোন কোন ক্ষেত্রে মেরামত করা সম্ভব হলেও তা বেশি দিন টেকে না। এসব মোবাইল ফোন সেট কিনে রীতিমতো ভোগান্তি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ব্যবহারকারীরা।
গ্রাহকরা শুধুই ঠকছেন!
একটি মোবাইলফোন অপারেটরের কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সিম্ফনি মোবাইলের টাচ স্ক্রিন প্রযুক্তি মোটেই ভালো নয়। দাম অনুয়ায়ী ফিচারের সংখ্যা বেশী তাই সব কাজ করেনা আর হ্যাং হয় বারবার।
তিনি বলেন, আমি ডি ৬৫ ব্যবহার করি এবং এটাকে এখনো জিপিআরএস মডেম ব্যবহার করার ১ মাসের পর এটার ইন্টারনেট আর কাজ করেনা।
ফোন বিজনেসম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিজামুদ্দিন জিটু বাংলানিউজকে বলেন, একটি চক্র নিম্নমানের হ্যান্ডসেট বিক্রি করে প্রতি বছর ক্রেতাদের কাছ থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে । টেলিভিশন ও পত্রিকায় চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে নানা সুযোগ সুবিধার কথা বলে নকল ও নিম্নমানের মোবাইল সেট দিয়ে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণায় নেমেছে। তাই এ ব্যপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী রিপা বলেন, আমি ৯ হাজার ৪৯০ টাকা দিয়ে এক্সপ্লোর ডব্লিউ ২৫ কিনে ব্যবহার করতে পারিনি। এটির অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েড হলেও এটা আসলে কোনো মানসম্পন্ন সেট নয়। কারণ ক্যামেরা নিম্নমানের এবং টাচ স্ক্রিন কাজ করেনা।
মেমোরি কার্ড ৩২ গিগাবাইট সার্পোট করার কথা থাকলেও ৪ গিগা দিলেই হ্যাং হয়।
সিম্ফনির ডব্লিউ ৬০ সেটটির ব্যপারে ব্যাংক কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেন, সেটটিতে ১গিগাহার্টজ সিঙ্গেল কোর প্রসেসর আর ৫১২ মেগাবাইট র্যাম ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। অথচ এই সেটটির গতি খুবই সেøা। সেটটি কিনে বিপদে পড়েছি।
পুলিশ সদস্য আরাফাতুল ইসলাম বলেন, ডব্লিউ ৯০ এর ক্যামেরা ৫ মেগাপিক্সেল হওয়াা সত্ত্বেও মান খুব খারাপ। হেডফোনে গান শুনতে গেলে আসল সাউন্ড পাওয়া যাবে না। কারন ফোন এর সাথে যে হেডফোনটি দেওয়া হয়েছে তা একেবারে নিম্নমানের। অথচ এই ফোনটির দাম রেখেছে ১৪ হাজার ৪৯০ টাকা। এদের প্রতারণার অবসান হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সময় ১২৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৩
এমআইআর/এমএমকে