ঢাকা: কেমন হবে ২০৫০ সালের পৃথিবী! বর্তমানের বাস্তবতায় ভবিষ্যতের পৃথিবীর কথা ভেবে অনেকেই চিন্তিত।
জলবায়ু পরিবর্তন, বর্ধিত জনসংখ্যা আর সঙ্কুচিত হতে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের কথা ভেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দের ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান।
তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, গবেষকরা জানিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্ম অনেক আরাম আয়েশেই থাকবে।
যুদ্ধবিগ্রহ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির মত সমস্যা তো থাকবেই, কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবিকাশে উঁকি দেবে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
গবেষকদের মতে ২০৫০ সার নাগাদ বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির মিলিত উৎকর্ষে মানুষের জীবনযাত্রা হবে অনেক বেশি চিত্তার্ষক। গাড়ি চালাতে লাগবে না চালক, প্রেমিকা না জুটলেও অসুবিধা নেই, মিলবে কৃত্রিম প্রেমিকা, এমনকি অমরত্ব লাভের সুযোগও থাকবে সেই প্রজন্মের সামনে।
২০৫০ সালে পৃথিবীর জীবনযাত্রা কেমন হবে তার একটি রূপকল্প তুলে ধরেছে খ্যাতনামা সাময়িকী ‘বিজনেস ইনসাইড’। সেই রূপকল্প অবলম্বনে কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের পৃথিবী তার একটি কথাচিত্র তুলে ধরা হলো বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য।
পূর্ণ হবে অমরত্ব লাভের স্বপ্ন!
আগামী দশকগুলোতে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন কম্পিউটারে মানব মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করতে সফল হবেন তারা । এর মাধ্যমে আজীবনের জন্য কৃত্রিম শরীরের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবে মানুষ, পূর্ণ হবে অমরত্বের স্বপ্ন!
রাশিয়ান ধনকুবের দিমিত্রি ইসকোভের অর্থায়নে নিউরোসাইন্টিস্ট র্যান্ডাল কোয়েন চেষ্টা করছেন মানব চেতনা ও মস্তিষ্ককে যেন আগামী ২০৪৫ সালের মধ্যে কৃত্রিম শরীরে প্রতিস্থাপন করা যায়।
এমনকি এখন যারা বেঁচে আছেন তারা মারা গেলেও এক সময় নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে তারা বেঁচে উঠবেন, কৃত্রিমভাবে সংরক্ষিত নিজেদের মস্তিষ্কের সাহায্যে। এমন আশার কথা শোনাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
এজন্য বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন কেমিক্যাল সলুশনের মাধ্যমে কিভাবে মস্তিষ্ককে অনন্তকাল সতেজ রাখা যায়।
এ ব্যাপারে ব্রেন প্রিসার্ভেশন ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানী কেনেথ হেইওয়ার্থ বলেন, আমরা যদি মস্তিষ্ককে আজীবন সংরক্ষণের উপায় বের করতে পারি তাহলেই সম্ভব হবে দ্বিতীয় উপায়। এমনকি ২০১৫ সালের মধ্যেই মস্তিষ্ককে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের নতুন উপায় আবিষ্কার হবে বলেও তার ধারণা।
বের হবে এইডস আর ক্যান্সারের প্রতিষেধক!
যদিও আমরা জানি না ভবিষ্যতে আর কোন ধরনের রোগ আমাদের সামনে হুমকি হিসেবে দেখা দেবে, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে এখনকার সবচেয়ে প্রাণঘাতী রোগগুলো থেকে মুক্তি মিলবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। এমনকি উদ্ভাবিত হবে ক্যান্সার ও এইচআইভি প্রতিষেধকও!
গবেষকরা আশাবাদী আগামী ২০ বছরের মধ্যে তারা এমন টিকা আবিষ্কার করতে পারবেন যার দ্বারা এইডস প্রতিরোধ সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ লোক মারা যায় এইডস রোগে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব লাইসেস্টার এনএইচএস ট্রাস্টের কনসালট্যান্ট মার্টিন উইসেলকা এ ব্যাপারে বলেন, ভবিষ্যতে আমাদের গবেষকরা এমন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারবেন যার মাধ্যমে এইচআইভি’র মত ভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে।
ক্যান্সারও নির্মূল হবে। উদ্ভাবিত ন্যানোপার্টিক্যাল ক্যানসার স্টেম সেলে আক্রমণ চালিয়ে ক্যান্সারের জীবাণুকে ধ্বংস করবে। উদ্ভাবিত হবে ক্যান্সার ভ্যাক্সিন।
তাছাড়া প্রায় সম্পূর্ণভাবে দূর হবে ম্যালেরিয়ার মত রোগ। প্রতিষেধকের পাশাপাশি ম্যালেরিয়ার বাহক মশাদের ধ্বংস করতে উদ্ভাবন হবে জেনেটিক্যালি মডিফাই মশা। আলঝেইমার রোগেরও কারণ ও প্রতিকার বের হবে। মেনিনজাইটিস রোগের প্রতিষেধক ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
মিলবে কৃত্রিম প্রেমিকা!
২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরও ইতিবাচক প্রয়োগ হবে। কার্নেগি মেলোন ইউনিভার্সিটির রোবোটিক ইন্সটিটউটের হ্যান্স মোরাভেক বলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে স্বাধীনভাবে ঘুড়ে বেড়ানো রোবোট মানুষের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ অনেক অনেকটাই কমিয়ে দেবে। বেঁচে যাওয়া এই সময় মানুষকে সুযোগ করে দেবে আরও বেশি করে সামাজিক ও বিনোদনমূলক কাজে সম্পৃক্ত হবার। এছাড়া গবেষণাগারে কাজ করতে দেখা যাবে রোবোট বিজ্ঞানীদের।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে উদ্ভাবিত হবে আবেগ অনুভূতি সম্পন্ন রোবোট। এমনকি রোবোট হবে মানুষের শয্যাসঙ্গী। মানুষ তার জৈবিক চাহিদা মেটাবে কৃত্রিম মানুষের মাধ্যমে। মানুষের মতই যৌন আচরণ করতে পারবে তারা।
২০৫০ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের এ যাবৎকালের অর্জিত জ্ঞান বিজ্ঞানকে ধারণ করতে সক্ষম হবে। তাদের মানুষের মত অনুভূতি থাকবে, এমনকি বুদ্ধিমত্তার সাথে কথাবার্তা চালানোর পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কও তৈরি করবে তারা।
ইন্টারনেটের জালে ধরা পড়বে পুরো বিশ্ব!
২০৫০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট পৌঁছে যাবে বিশ্বের সর্বত্র। ব্যবহারকারী হবে বিশ্বের প্রায় সবাই।
ফোরাম ফর দি ফিউচার ফাউন্ডারের গবেষক জোনাথন পোরিট ধারণা করছেন ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৯৮ ভাগ বা ৮শ’ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, যার অনেকেই সংযুক্ত হবেন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। বর্তমানে বিশ্বের ৪০ শতাংশ লোক ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আছেন।
গুগলসহ বিশ্বের আরও অনেক তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের সবখানে ইন্টারনেট ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে।
গাড়ি চলবে নিজের বুদ্ধিতে !
আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই যানবাহনের জন্য কোনো ড্রাইভারের প্রয়োজন হবে না। মিলকেন ইন্সটিটউটের তথ্য মোতাবেক ২০৩৫ সালের মধ্যেই পৃথিবীর সব গাড়ি হবে চালকমুক্ত। মানবীয় ভুলের সম্ভাবনা না থাকায় এই সব চালকবিহীন গাড়ি হবে বেশি নিরাপদ।
এছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির জয়জয়কার হবে। ইতালীয় জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইনেলের মতে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর বিশ্বে ইলেক্ট্রিক গাড়ির উৎপাদন দাঁড়াবে ১০ কোটিতে। যা সারা বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৩০ শতাংশ হ্রাস করবে।
শিশুর অকাল মৃত্যু আর হবে না !
চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগেও শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি দূর হয়নি পৃথিবী থেকে। এখনও বিশ্বের দেশে দেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন চলতি শতকের মাঝামাঝি নাগাদ এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছে পৃথিবী।
গবেষণা সংস্থা কোপেনহেগেন কনসেনসাসের পূর্বাভাস অনুযায়ী পূর্ববর্তী কয়েক দশকে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে শিশু মৃত্যুর হার দ্রুতগতিতে কমে এসেছে, এই ধারা আরও গতিশীল হবে পরবর্তী কয়েক দশকে।
ইউনিসেফের তথ্য মোতাবেক ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি হাজারে ৯০ থেকে ৪৮। ২০৫০ সালের মধ্যে এই হার নেমে আসবে প্রায় শূণ্যের কোঠায়।
এই সময়ের মধ্যে আবিষ্কার হবে মায়ের থেকে শিশুদের এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায়। পাশাপাশি পুষ্টিহীনতা ও রোগ প্রতিরোধের নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কৃত হবে এই সময়ের মধ্যে যা জন্মের পরপরই শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনাকে তিরোহিত করবে অনেকখানিই।
গরিব দেশ আর গরিব থাকবে না !
২০৩৫ সালের মধ্যেই ‘গরিব’ এমন অপবাদ থেকে মুক্ত হবে এখনকার অনেক ‘গরিব দেশ’। গত বছর এমন পূর্বাভাস করছিলেন বিল গেটস।
গবেষকরা জানাচ্ছেন আসলেই সম্ভব হবে বিল গেটসের স্বপ্ন। ২০৫০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর কথিত গরিব দেশগুলো তাদের গরিবী তকমা ছুড়ে ফেলতে পারবে।
ধারণা করা হচ্ছে, যদি স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখে তবে ২০৫০ সালে চরম দরিদ্র লোকের সংখ্যা ২.৫ শতাংশে নেমে আসবে। বর্তমানে এই হার ২১ শতাংশ।
গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমবে ৮০ ভাগ !
২০৫০ সালের মধ্যে বাড়বে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত জ্বালানির ব্যবহার। গ্রিসহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমবে ৮০ ভাগ। বাড়বে রিনিউবেল এনার্জির ব্যবহার।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবার কাছে প্রয়োজনীয় জ্বালানি পৌঁছে যাবে, যার ৯৫ শতাংশই হবে রিনিউবেল এনার্জি।
২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে সৌরশক্তি থেকে। ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বায়ুশক্তি থেকে। এছাড়া সাগরের ঢেউ এবং জিয়োথার্মাল পাওয়ারের মাধ্যমেও উৎপাদিত হবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি।
নারী পুরুষ সমানে সমান
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মোতাবেক ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব থেকে দূর হবে লিঙ্গ বৈষম্য। নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর হয়ে সমাজে বিরাজ করবে সামাজিক সমতা।
সন্তানকে দেখাশোনার পাশাপাশি পারিবারিক কাজে সমান সমান সময় দিতে হবে নারী পুরুষকে। নারীরা যে কোনো কাজে পুরুষের সমান অনুপাতে অংশগ্রহণ করবে এবং সমান বেতন পাবে।
নিরক্ষরতা হবে দূর
বর্তমানে বিশ্বের ২৩.৬ শতাংশ লোক লিখতে পড়তে জানেন না। কিন্তু কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের মতে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই হবে লেখাপড়া জানা। নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা নেমে আসবে মাত্র ১২ শতাংশে। এ সব শিক্ষিত মানুষ ভূমিকা রাখবেন স্ব স্ব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
এ সব ভবিষ্যদ্বাণী যদি সত্যিই বাস্তবে পরিণত হয় তবে ভাবুন তো কেমন হবে ২০৫০ সালের পৃথিবী। অনেকের কি আফসোস হচ্ছে না কেন এত তাড়াতাড়ি এলাম এ পৃথিবীতে, এই ভেবে !
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৪